স্নায়ুর লড়াই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে, ইতিহাসে এই প্রথম মেয়রের নোটিশ সিইওকে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটেছে। গৃহকর নির্ধারণে অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। সোমবার (২৭ অক্টোবর) এ নোটিশ জারি করা হয়, যেখানে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে তাকে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে এটাই প্রথমবার, কোনো মেয়র সরাসরি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে আগে থেকেই মেয়র শাহাদাতের সঙ্গে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছিল।

ঘষামাজায় উধাও ৪০ কোটি টাকা

নথি অনুযায়ী, দুটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংয়ে কর নির্ধারণে ঘষামাজা করে প্রায় ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ ওঠে। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে মধ্যম হালিশহরের এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে অবস্থিত ইনকনট্রেড লিমিটেডের গৃহকর নির্ধারণে এসেসর ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা ও ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা বার্ষিক মূল্যায়ন ধার্য করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে রিভিউ শুনানিতে ‘ফিল্ডবুক’ ও ‘পি ফরম’ থেকে ‘২’ সংখ্যা ঘষে মুছে ফেলে যথাক্রমে ৫ কোটি ৬৭ লাখ এবং ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা দেখানো হয়। এতে দুই প্রতিষ্ঠানের কর মূল্যায়ন কমে যায় ২০ কোটি টাকা করে, মোট ৪০ কোটি টাকা।

তদন্তে ঘুষ-অনিয়মের প্রমাণ

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ১৩ জুন এছাক ব্রাদার্স এবং ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইনকনট্রেড লিমিটেডের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে অডিটে বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর গত জানুয়ারিতে আইন কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মুরাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

গত ২০ ও ২১ অক্টোবর মেয়রের হাতে দুটি পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে, যেখানে কর ঘষামাজার সত্যতা পাওয়া যায়। এর পরদিন ২২ অক্টোবর কর কর্মকর্তা নুরুল আলম ও উপকর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিন হিসাব সহকারী—মঞ্জুর মোর্শেদ, রূপসী রাণী দে ও আহসান উল্লাহকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উপকর কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধেও অনিয়মের প্রমাণ মেলে, তবে তিনি অবসরে থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

একই ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২৩ অক্টোবর টাইগারপাস কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অনিয়মের সত্যতা পায়। দুদক এ ঘটনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখছে।

নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে নোটিশ

নোটিশে বলা হয়েছে, গৃহকর নির্ধারণে এই অনিয়ম ২০২৩ সালের ২৮ মে কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, দোষী শনাক্তকরণ এবং নতুন করে কর নির্ধারণের কোনো পদক্ষেপ নেননি।

তার এই নিষ্ক্রিয়তার কারণে সিটি করপোরেশন বিপুল রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯–এর ৬২(২) ধারায় বিষয়টি দায়িত্বে অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ বলে উল্লেখ করা হয়।

মেয়রের নির্দেশে নতুন পদক্ষেপ

নোটিশে আরও বলা হয়েছে, গত ৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রশিক্ষণের জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এরপর মেয়রের নির্দেশে তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং পুনরায় রিভিউ করে কর নির্ধারণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নোটিশের অনুলিপি প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চট্টগ্রাম পরিচালককে পাঠানো হয়েছে।

‘আমি বুঝতে পারছি না, কেন নোটিশ’

রাতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। বিষয়টি আমার নজরে আসার পরই করপোরেশনের আইন কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করি এবং দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে তাগাদা দিই। তদন্ত দেরিতে জমা পড়েছে কেন, তা কমিটির প্রধানই ভালো জানেন। আমার করণীয় ছিল যথাযথ কমিটি গঠন করা, সেটিই করেছি। এরপরও কেন আমাকে নোটিশ দেওয়া হল, আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।’

স্নায়ুযুদ্ধে চসিক প্রশাসন

প্রশিক্ষণ শেষে গত বুধবার (২২ অক্টোবর) ফেরার পরও শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের যোগদানপত্র গ্রহণ করা হয়নি। আগেরদিনই মেয়র অফিস আদেশে জানিয়েছেন, তার যোগদানপত্র গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত করপোরেশনের সব নথি সচিবের মাধ্যমে মেয়রের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে।

ksrm