স্ট্রোকে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ হারাচ্ছে চট্টগ্রাম, চার বছরে মোটে ২০ রোগী পেলেন ৫৫ হাজারের থ্রম্বোলাইসিস

মেডিকেলের স্ট্রোক ইউনিট কাগজে-কলমেই

মানুষ স্ট্রোক করলে প্রথম চার ঘণ্টা সময়কে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে বেশিরভাগই রোগী এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিতে আসেন না। ফলে চিকিৎসা তেমন কাজ করে না, অনেকে পঙ্গু হয়ে যান, আবার অনেকে মারাও যান। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্ট্রোকের চিকিৎসায় চার বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ‘থ্রম্বোলাইসিস’ প্রক্রিয়া। এখনও পর্যন্ত মাত্র ২০ জন রোগী এই সেবা পেয়েছেন।

একইসঙ্গে নিউরোলজি ওয়ার্ডে নেই পর্যাপ্ত শয্যা। রোগীদের থাকতে হয় বারান্দায়। এমন পরিবেশে থাকতে গিয়ে রোগীরা অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা দিতেও বেগ পেতে হয় নার্স ও ডাক্তারদের।

স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৪ হাজার ১২৭ জন। মারা গেছেন ৪৩৬ জন। ২০২৪ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৮৯১ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ১১৬ জন। অন্যদিকে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যনন্ত স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৮৪৮ জন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৮ নম্বর নিউরোলোজি ওয়ার্ডে উন্নতমানের স্ট্রোকের চিকিৎসাসেবা দিতে চার বছর আগে চালু হওয়া বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিট এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। ফলে আলোর মুখ দেখনি আধুনিক ‘থ্রম্বোলাইসিস’ চিকিৎসা প্রক্রিয়া।

বেহাল বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিট

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৮ নম্বর নিউরোলোজি ওয়ার্ডের ভেতরে বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিট কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছিল। কিন্তু এই ইউনিটের সামনের দরজা খুলে ফেলা হয়েছে। আলাদা কোনো চিকিৎসাসেবার সুযোগ নেই এখন। অথচ স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে মৃত্যুহার ও পঙ্গুত্ব কমানোর লক্ষ্যে ২০২১ সালে সরকারিভাবে বিশেষায়িত এই স্ট্রোক ইউনিট চালু করা হয়।

নিউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি চালু করা ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, জনবল এবং ওষুধের সরবরাহ না থাকায় এখনও নিয়মিতভাবে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি।’

‘থ্রম্বোলাইসিস’ বাঁচাতে পারে প্রাণ

স্ট্রোক চিকিৎসায় থ্রম্বোলাইসিস থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে বিবেচিত। স্ট্রোকের সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে রোগীর শরীরে বিশেষ ইনজেকশন প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের রক্তনালীর জমাট রক্ত ভেঙে দেওয়া হয়। এতে রোগী অনেক ক্ষেত্রে পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা পান।

কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলে এই ইনজেকশন রোগীদের নিজ খরচে কিনতে হয়, যার দাম প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার টাকা—অনেকের পক্ষে যা ব্যয়বহুল।

১৮ নম্বর নিউরোলোজি ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. সামী এম. আদনান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্ট্রোক রোগী ১৪ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় পরে হাসপাতালে আসেন। অথচ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রথম ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিটকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘গোল্ডেন আওয়ার’। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগী প্রায় সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হতে পারেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে রোগীরা সেই সময়টাই হারিয়ে ফেলছেন।’

‘সেকেন্ডারি লাইফ সিস্টেমই দায়ী’

ডাক্তাররা বলছেন, বর্তমানে মানুষ কোনো ধরনের ব্যায়াম করেন না। নিয়মিত চেকআপ করেন না। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলে রোগী জানতে পারেন, তার কি কি সমস্যা রয়েছে শরীরে।

স্ট্রোকের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ডা. আদনান বলেন, ‘সেকেন্ডারি লাইফ সিস্টেমই স্ট্রোকের জন্য দায়ী। কারন আমরা মুভমেন্ট করি না। ভ্যাকেল ডিপেন্ডডেন্ট হয়ে গেছি। ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করছি না। হার্ট-লাঞ্চের ওয়ার্কলোড হচ্ছে না। ব্রেনের সার্কুলেশন ব্লক হয়ে যাচ্ছে। এ রোগের প্রধান কারন প্রেসার, ডায়াবেটিকস, রক্তের চর্বি, স্মেকিং, সুষম খাদ্যের অভাব। স্ট্রোক দুই ধরনের—রক্তনালী ব্লক ও রক্তনালী ফেটে যাওয়া।’

তিনি বলেন, ‘রোগীকে ৩ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে বাঁচানো সম্ভব হয়। ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট প্রগ্রেসিভ করলে রোগী বেঁচে যায়। থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসায় যতটুকু সম্ভব রক্তের চর্বি খুলে দেয়।কিন্তু এ ইনজেকশন রোগীরা নিজের টাকা খরচ করে কিনতে চান না। গত ৪ বছরে এখনও পর্যন্ত ২০ জনকে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এটি পরিচালনার জন্য বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিটের ভেতরে সিটিস্ক্যান মেশিন, ক্যাথল্যাব থাকা প্রয়োজন।’

ডা. আদনান বলেন, ‘স্ট্রোকে প্রিভেনটেশনটাই বড় বিষয়। একটা পাশ অবশ হয়ে যায়। অবশের কোনো মেডিসিন নেই। ৩৩ শতাংশ অবশ খুলতে নিউরোলোজি, ফিজিক্যালি মেডিসিন, ফিজিওথেরাপি কোলাবেরেশন লাগে। এ অবশকে অ্যাড্রেস করে ফিজিওথেরাপিস্ট। তাই চিকিৎসকদের প্রথমেই ফাইন্ড আউট করতে হবে, কি কারণে স্ট্রোক হলো। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এমনও রোগী পাই, যারা স্ট্রোক হওয়ার পর ডায়াগোনোসিস করে জানতে পারেন’ তার প্রেসার, কিডনি, হার্টের সমস্যা রয়েছে। স্ট্রোক হবার পরই তিনি জানতে পারেন তার কি সমস্যা। তাই সবারই ৫০ বছরের পর রেগুলার চেকআপ করা উচিত। তবে ওয়ার্ডে রোগীদের সিটিস্ক্যান করার সুযোগ নেই। আর অনেক রোগীর বাইরের ল্যাবে গিয়ে সিটিস্ক্যান করার সামর্থ্য থাকে না।’

চিকিৎসা নিতে দেরি

ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ রোগীই স্ট্রোক হবার এক থেকে দুদিন পর হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। রোগীদের কেসস্টাডিতে উঠে এসেছে, স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি, যাতায়াতের দুরবস্থা এবং রেফারাল প্রক্রিয়ার ধীরগতি। ফলে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ ফসকে গেছে তাদের।

এমনই একজন মুনতাসুল ওয়ারা (৩৮)। বাড়ি সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায়। জ্ঞানহীন হয়ে ভর্তি রয়েছেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে, পাশে মেয়ে বসে আছে। গত রোববার (২৭ অক্টোবর) কথা হয় ওয়ারার বড়বোনের সঙ্গে।

তার বড়বোন জানান, সাড়ে তিন বছর আগে সিজারে ডেলিভারি হয়েছিল। গর্ভাবস্থায় প্রেসার থাকায় প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত খেতেন মুনতাসুল। কিন্তু ডেলিভারির পর ওষুধ নিয়মিত খেতেন না। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাতে হঠাৎ হাত-পা অবশ হয়ে যায়। বুধবারে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়।

সাতকানিয়ার দক্ষিণ ঢেমশার বাসিন্দা কুলসুম হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। স্ট্রোকে একপাশ অবশ হয়ে গেছে তার। স্ট্রোক করার তিনদিন পর তাকে ওয়ার্ডে ভর্তি করান তার স্বামী।

ফেনী ফুলগাজীর বাসিন্দা আব্দুল হক (৬২) হাসপাতালে ভর্তি হন তিনদিন আগে। তিনি জানতেন না তার ডায়াবেটিকস হয়েছে। তিনদিন আগে মাথা ঘুরে পড়ে যান আবদুল হক। তখনই স্ট্রোক করে ফেলেন আব্দুল হক। ডায়াবেটিকস শূন্য হয়ে গিয়েছিল তার।

ফলোআপ করান না রোগীরা

স্ট্রোকে আক্রান্তদের জন্য সপ্তাহে একদিন ফলোআপের ব্যবস্থা রয়েছে। বৃহস্পতিবার ডাক্তাররা রোগীদের দেখে ফলোআপ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর রোগীরা ফলোআপ করাতে আসেন না।

ডা. আদনান বলেন, ‘আমরা রোগীদের ট্রিটমেন্ট নিয়ে যাওয়ার সময় সবসময় বলি, থেরাপি কন্টিনিউ করতে হবে। বৃহস্পতিবার ফলোআপ-ডে থাকে। স্ট্রোকের রোগীদের ফলোআপে দেখা করতে বলি। ওষুধের ব্যাপারে নির্দেশনা থাকে।’

সরঞ্জাম ও স্থান সংকটে চিকিৎসকরা

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৮ নম্বর নিউরোলোজি ওয়ার্ডে বেড সংকট এখন প্রকট। প্রায় রোগীদের লিফটের পাশে, করিডরে বা বারান্দায় রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। রোগীদের মাল্টিফ্যাকটরিয়াল সমস্যা দেখা দেয়। অন্য ওয়ার্ডের সঙ্গে কোলাবোরেট করতে হয়।

ডা. আদনান বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা ও সক্ষমতা থাকলেও পরিকাঠামো না থাকায় নিয়মিত থ্রম্বোলাইসিস দিতে পারছি না। ওয়ার্ডে জায়গা সংকট ভয়াবহ।’

ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, মেঝেতে এবং ওপরে মিলে ৮৩টি বেডের ব্যবস্থা থাকলেও রোগী ভর্তি থাকে ১২০ থেকে ১৩০ জন। রোগীদের বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় রাখতে হয়। বাইরে স্যালাইন স্ট্যান্ড না থাকায় রোগীদের চিকিৎসা দিতেও বেগ পেতে হয়।

ডিজে

ksrm