সৌদি মরুর বুকে স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী চট্টগ্রামের দুই প্রবাসী

ধারদেনা-প্রতারণা-এককাপড়ে দেশে ফেরা

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নের মফিজুর রহমানের ছেলে মুজিবুর রহমান। অন্য দু চারজন প্রবাসীর মতো ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ধার-দেনা করে পাড়ি জমিয়েছিলেন মরুর দেশ সৌদি আরবে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি এখন দিশেহারা! বাংলাদেশ থেকে জেদ্দা, এরপর জেদ্দা থেকে পালিয়ে রিয়াদ। আর রিয়াদ থেকে গ্রেপ্তার হয়ে এক কাপড়ে দেশে ফিরলেন মুজিব। দেশে ফেরার পর এখন কী করবেন— তা ভেবেই তিনি আকুল।

মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, স্থানীয় একটি ব্যাংকে পৈত্রিক ভিটেবাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সে সৌদি আরবের জেদ্দায় গিয়েছিলাম। ভিসা দিয়েছেন আমার আপন চাচাতো ভাই। সৌদি আরব যাওয়ার পর দেখি যে কফিলের অধীনে ভিসা হয়েছে, তার কোন হদিস নেই। এক মাস অপেক্ষা করেছি, কফিল (ভিসা প্রদানকারী সৌদি নাগরিক) আমাকে রিসিভ করতে আসেননি।

YouTube video

যিনি ভিসা দিয়েছেন সেই চাচাতো ভাইও কি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি— প্রশ্ন করলে তিনি জানান, আমি ভিসা আরেকজনের কাছে নিয়েছি। তিনি একজন কফিল ম্যানেজ করলেন। কফিল আমার মেডিকেল টেস্ট করালেন। রিপোর্ট আসলো আমি আনফিট। আমার হার্ট আর কিডনিতে সমস্যা আছে। মেডিকেল ফিট সার্টিফিকেট করাতে ৪ হাজার সৌদি রিয়াল দাবি করলেন। ৪ হাজার রিয়াল দিতে না পারলে বেতন ছাড়া পেটে-ভাতে কাজ করার সুযোগ দিতে ইচ্ছুক হলেন সেই কপিল।

তিনি বলেন, ‘এভাবে একমাস কাটলো কর্মহীন। চলছিলাম অর্ধাহারে, অনাহারে। বাড়িতে ঋণের কিস্তির সময়ও ঘনিয়ে আসছিলো। তখন সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের কাছে পালিয়ে যাই। রিয়াদে ওই আত্মীয় একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। মাসিক এক হাজার ৭০০ রিয়াল বেতনে। ৩ মাস পরপর বেতন দেবে ওই মালিক— কথা ছিল এমনই। প্রথম ৩ মাস কাজ করার পর ৫ হাজার ১০০ রিয়াল বেতন পেয়েছি।

শেষ ৩ মাসের বেতন তোলার আগেই একদিন ভারতীয় শ্রমিক আর বাঙালিদের মাঝে গণ্ডগোল বাঁধলো। আমি মসজিদে ছিলাম। মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর বাঙালি-ভারতীয়রা মিলে আমিসহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করলো। আমাদের থানায় নিলো। থানা থেকে কারাগারে। আবার কারাগার থেকে থানায়। এভাবে ১৪ দিন কেটে গেল। যেদিন দেশে পাঠাবে সেদিন পরনের প্যান্টের বেল্টটিও (কোমরবন্ধ) খুলে নিয়েছে সৌদি পুলিশ। অথচ সৌদিতে কাজ করার জন্য আমার আকামা ছিল, ভিসার মেয়াদও ছিল।

YouTube video

বিদেশ যেতে হলে দেশ থেকে মেডিকেল টেস্ট করিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং যে ভিসায় যাবেন সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু আপনি এটা কেন অনুসরণ করেননি? জবাবে মুজিব জানান, ভিসা দিয়েছেন আমার আপন চাচাতো ভাই। ওরাই বারবার বলেছেন মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে না। মেডিকেল টেস্ট করানোর রেফারেন্স তো ভিসা দাতারা দেন। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাই আমিও করাইনি, কন্ট্রাক্টে গিয়েছি।

সৌদিতে জানানো হলো আপনার হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা আছে, এখানকার চিকিৎসকরা কী বলেন— জানতে চাইলে মুজিব জানান, ‘আল্লাহর রহমতে এসব রোগের স্বাভাবিক যেসব লক্ষণ তাও কখনো আমার দেখা দেয়নি। আমি তো নিয়মিত কাজ করছি। বিদেশ যাওয়ার আগে সিটি সার্ভিস বাস চালিয়েছি, লবণ মাঠে কাজ করেছি। কখনও সমস্যা হয়নি। আল্লাহর রহমতে এখনও সুস্থ আছি।’

অনুমোদন তিনজনের, ভিসা বিক্রি ১০ জনকে
সাতকানিয়ার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মৃত আবদুল মজিদের ছেলে মহিউদ্দিন। তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন দোকান কর্মচারীর ভিসায়। সৌদি গিয়ে দেখেন কফিলের কর্মচারীর অনুমোদন আছে তিনজনের। তিনি ভিসা বিক্রি করেছেন ১০ জনকে। মহিউদ্দিন আর ওই নির্ধারিত কফিলের অধীনে কাজ করা হয়নি। ওখান থেকে পালিয়ে অন্য দোকানে কাজ নিলেন, যা সৌদি আইনে অবৈধ। তাও কথা বলে নেওয়া হয়েছে তার গাড়িই নেই।

মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, পালিয়ে একটি দোকানে মোবাইল মেরামতের কাজ নিই। প্রথমে কষ্ট হয়েছে। যেহেতু প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছি, টাকা তো তুলতে হবে। কষ্ট করে থেকে গেলাম। পুলিশ তল্লাশি করতে আসলে লুকিয়ে থাকতাম। একবার গ্রেপ্তারও হয়েছি। দুই হাজার রিয়াল জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাই। শেষ গত মে মাসে গ্রেপ্তার হই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে বিমানবন্দর নিয়ে এসে দেশে পাঠিয়ে দেয়। পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি।

মহিউদ্দিন আরো জানান, বিমানে ওঠানোর আগে বিমানবন্দরে বাঙালি নারীদের দেখলাম। তাদের শরীরে নির্যাতনের ছাপ ছিল স্পষ্ট। তাদের দেখে নিজের কান্না ধরে রাখতে পারিনি। তাই যারা বিদেশ যাবেন তারা যেন সব কিছু নিশ্চিত হয়ে যান। আমার মতো বিপদে যেন কেউ না পড়েন।

অনেক গ্লানি নিয়ে দেশে ফিরেছেন মুজিব ও মহিউদ্দিন। স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় দিন পার করছেন তারা।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন গিয়েছেন আত্মীয়ের মাধ্যমে। যার কারণে তারা প্রতারিত হয়ে ফিরে এসেছেন। সেই আত্মীয়রাও ভিসা নিয়েছেন দালালের কাছ থেকে। তাই যারা বিদেশ যাবেন তারা দালালের কাছ থেকে ভিসা কেনার বিষয়ে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। সরকারীভাবে যদি উনারা রিক্রুট হতেন তবে সরকার বিষয়টি সৌদি সরকারকে অবহিত করতে পারতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারেরও আইনী বাধা আছে। দালাল ধরে যাওয়া ভিসার ব্যাপারে সরকারেরও কিছু করার থাকে না।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm