সৌদি আরবের আজিজই বায়েজিদের সন্ত্রাসী মুন্না, শেষমেশ ধরা পুলিশের হাতে
খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ— ওস্তাদ সবকিছুতেই
আসল নাম তার বেলাল উদ্দিন মুন্না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পালিয়ে ছিলেন ‘আবদুল আজিজ’ পরিচয়ে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। শেষমেশ ধরা পড়তেই হলো তাকে। বেলাল উদ্দিন মুন্না চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলী হত্যার অন্যতম প্রধান আসামি। দীর্ঘদিন নাম-ঠিকানা গোপন করে সৌদি আরবে পালিয়ে ছিলেন তিনি।
সৌদি আরবে গিয়ে নিজের নাম বদলে রাখেন আবদুল আজিজ আর পিতার নাম বদলে রাখেন আবদুর রহমান। চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত এইট মার্ডারের নেতৃত্বদানকারী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল শিবির ক্যাডার মুন্না।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ কমিশনার জহিরুল ইসলাম জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার (৩ আগস্ট) রাতে বায়েজিদ থানাধীন চালতাতলী এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে বেলাল উদ্দিন মুন্না (৪৩), তার সহযোগী হাজি পাড়ার আবদুল মালেকের ছেলে মো. নাজিম উদ্দিন হিরুকে (৩৪) গ্রেফতার করা হয়েছে।
এর আগে গত ১ আগস্ট গাড়ি থেকে চাঁদাবাজির ঘটনায় মুন্নার এক সহযোগীকে গণধোলাই দেয় স্থানীয় জনতা। তাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে মুন্না ও তার ভাই জসিম উদ্দিন প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে দেয়। মূলত এরপর থেকেই পুলিশের নজরে ছিলেন মুন্না।
চট্টগ্রাম নগরীতে এযাবৎকালে ছাত্রশিবিরের যত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর উত্থান হয়েছে, তার বেশিরভাগই বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকা থেকেই।
মামলার অভিযোগসূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ২ জুন বায়েজিদ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেন শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ও তার সহযোগী মুন্না। এই মামলার এজাহারনামীয় অন্যতম আসামি এই বেলাল উদ্দিন মুন্না। ওই ঘটনার পর ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান মুন্না। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে পরে দেশে ফিরে আসেন।
জানা গেছে, গত ৫-৬ বছর ধরে সাজ্জাদ বাহিনীর নেতৃত্বভার যায় মুন্নার হাতে। তার হেফাজতে রয়েছে সাজ্জাদের বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারও। নগরীর বায়েজিদ, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ থানা এলাকায় বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে জমি ক্রয়-বিক্রয়, শিল্পকারখানা, এমনকি সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে গেলেও সাজ্জাদের হয়ে চাঁদার জন্য হানা দেন মুন্না। চাঁদা না দিলে চালানো হয় সন্ত্রাসী হামলা। জনমনে ভীতি বাঁচিয়ে রাখতে খুন করতেও পিছপা হয় না গ্রুপটি।
জানা গেছে, দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার মুন্নার চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি তার জন্মদাতা পিতা-মাতাও! মুন্নার বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে তার পিতা আব্দুস সাত্তার বায়েজিদ থানায় মামলা (নম্বর- ১৮(৫)১৬) দায়ের করেছিলেন। ওই মামলায় আটকের পর কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতের মাধ্যমে মুন্নাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন তার বাবা।
অনুসন্ধানে শিবির ক্যাডার মুন্নার হেফাজতে বিদেশি পিস্তল রিভলবার ছাড়াও একে-৪৭, একে-২২ এর মতো ভারি মরণাস্ত্র থাকার তথ্য রয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এসব অস্ত্র প্রদর্শন কিংবা অবাধ ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সাজ্জাদ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক সন্ত্রাসী অস্ত্রসহ আটক হয়। কিন্তু তাদের ত্রাস ও অস্ত্রের ঝনঝনানি থামেনি আজও। চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে মুন্না ইতিমধ্যে অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানা এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে মুন্নার নেতৃত্বে। প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ব্যবসায়ী থেকে বিত্তশালী প্রবাসীদের টার্গেট করেও চাঁদাবাজি চলছে গ্রুপটির। এমনকি চাঁদা আদায়ে অপহরণ করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, মুন্নার অধীনে অন্তত কয়েকশো সন্ত্রাসী সক্রিয়। উঠতি কিশোর যুবকদের টার্গেট করে অর্থের লোভে দলে টানেন মুন্না। পরে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। বায়েজিদ থানাধীন আপন নিবাস আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ভবন মালিকের কাছে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন বেলাল উদ্দিন মুন্না। দফায় দফায় ওই ভবনমালিককে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। গত ২২ মার্চ রাতে নির্মাণাধীন এই ভবন মালিকের নয়ারহাট এলাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালান মুন্না ও তার সশস্ত্র বাহিনী। এ সময় পুরো অফিসের জিনিসপত্র ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়। এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলার বেশকিছু দৃশ্য আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজেও উঠে আসে। এতে দেখা যায়, হামলায় অংশ নেয় ২০-২৫ জন সন্ত্রাসী। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াও ছিল ছুরি চাপাতিসহ পেট্রল বোমা। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মুন্না ও তার আট সহযোগীর নামে চাঁদাবাজি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
২০১৮ সালে পুলিশ বাদী হয়ে বায়েজিদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছিল শিবির ক্যাডার মুন্নার বিরুদ্ধে।
২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে নয়ারহাট ছায়াপথ কুঠির নামে বিল্ডিংয়ে সামনে থেকে তানভীরুল হক নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুন্না। চাঁদা না পেয়ে ওই ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা ছিল। তবে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তানভীরুল। ওই ঘটনায় মুন্নার বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় অপহরণ মামলা দায়ের হয়। মুন্নার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, বোমা বিস্ফোরকসহ অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে।
মুন্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা হলেন বায়েজিদ খন্দকার পাড়ার মোহাম্মদ আজিজ, নয়ারহাট ভক্তপুর এলাকার হারুন উর রশীদ, হাজীরপুল এলাকার মোহাম্মদ মাসুদ, চান্দগাঁও চাঁনমিয়া এলাকার ইমরান হোসেন, অদুর পাড়ার মোহাম্মদ হায়দার অন্যতম। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলাও রয়েছে।
সিপি