সোনা পাচারের কেন্দ্র চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, প্রতি ৫ ঘটনায় ধরা পড়ে একটি
দুবাই-সিঙ্গাপুর থেকে আসা চালান চলে যাচ্ছে ভারতে
গত ৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের এক নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের ৯ কেজি ২৮০ গ্রাম ওজনের ৮০টি সোনার বার উদ্ধার করা হল। টাকার অংক বড় হলেও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের জন্য এটি খুবই ছোট ঘটনা। কারণ নিয়মিতই এই বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে— যার খুব সামান্যই ধরা পড়ছে।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালানের বড় ঘাঁটি হয়ে উঠলেও সে তুলনায় সোনা উদ্ধারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এই চোরাচালানে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট লোকজন সরাসরি জড়িত— এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও এরা তো নয়ই, মূল হোতারাও থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা যায়, দেশে-বিদেশে সোনা পাচারের সিন্ডিকেট রয়েছে ৬০টিরও বেশি।
দেশের দুই প্রধান বিমানবন্দর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গত তিন বছরে দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে অবৈধ পথে দেশে নিয়ে আসা ৪২১ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে। অন্যান্য সংস্থা মিলিয়ে এই সংখ্যা হাজার কেজির বেশি। তবে বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের ঘটনার সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, সোনা চোরাচালানের পাঁচটি ঘটনার মধ্যে ধরা পড়ে মাত্র একটি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুর রউফ জানান, সোনা উদ্ধারের এসব ঘটনায় দু-একটি ক্ষেত্রেই শুধু বহনকারীদের আটক করা সম্ভব হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা।
শুল্ক গোয়েন্দারা জানাচ্ছে, সোনা চোরাকারবারিরা দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে আসা ৯৮ শতাংশ যাত্রীকে সোনা পাচারে ব্যবহার করছে। একজন যাত্রী লাগেজ-সুবিধার আওতায় দুটি করে সোনার বার আনতে পারেন। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। প্রতিটি বারে শুল্ক ২০ হাজার ও বহনকারীকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে বৈধভাবে সোনা আনা হচ্ছে।
ব্যাগেজ নীতিমালা অনুযায়ী, বর্তমানে যাত্রীরা বৈধপথে ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ বা দুটি বার (প্রায় ২০ ভরি) সঙ্গে আনতে পারেন। এর শুল্ককর ৪০ হাজার টাকা। আর নারী যাত্রীরা ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার করমুক্ত উপায়ে আনতে পারেন। একজন যাত্রী কতবার এই সুযোগ নিতে পারবেন, আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।
শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা, এ ধরনের স্বর্ণগুলো সংশ্লিষ্ট যাত্রী কিংবা বৈধ ব্যবহারকারীদের জন্য আসছে না। শুল্ক পরিশোধ করা যাত্রীরা কেবল বাহক হিসেবে কাজ করছেন। প্রত্যেক যাত্রী দুটি স্বর্ণের বার এনে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিচ্ছেন। এর বাইরে হয়তো বহন করার জন্য তিনিও কিছুটা আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। মূলত অবৈধ উপায়ে স্বর্ণ ধরার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে চোরাচালানকারীরা এ পথটি বেছে নিচ্ছেন। কেউ হয়তো ৬০টি স্বর্ণের বার বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে চাইছেন। তিনি এজন্য ৩০ জন যাত্রীকে দুটি করে বার দিয়ে দেবেন। এসব কাজে বিশ্বস্ত যাত্রীদের ব্যবহার করা হয়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার পর নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় এসব স্বর্ণ হাতবদল হয়ে যায়। এ সময় যিনি বহন করে আনছেন, তাকে চুক্তি অনুযায়ী ‘পারিশ্রমিক’ও দিয়ে দিচ্ছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন ও যেসব সংস্থার বিমানে সোনা আসছে, তাদের লোকজন পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া বিমান ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে সোনা চোরাচালান সম্ভব নয়। দেখা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বেশিরভাগ সোনাই উদ্ধার হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট থেকে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর উদ্ধার করা সোনার বারগুলোও বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে করেই চট্টগ্রামে আসে।
এ প্রসঙ্গে ড. আবদুর রউফ বলেন, ‘আমরা গত ২-৩টা স্বর্ণের চালান ধরলাম সব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স থেকে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের একজন নিরাপত্তা কর্মীকেও আমরা হাতেনাতে গ্রেপ্তার করলাম। প্রতিনিয়ত এ ঘটনা ঘটছে। তো কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। সে সংস্থার একটা পরিচালনা পর্ষদ আছে, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট আছে। তারা কি নৈতিকভাবে বলতে পারে আমাদের কোনো দায়িত্ব নাই?’
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত ৬৬ দশমিক ৯৬৪ কেজি সোনা আটক করা করেছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৭৪ দশমিক ৪৯ কেজি এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৮০ দশমিক ৩৫ কেজি সোনা জব্দ করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সোনার চাহিদা বছরে ১৬ থেকে ২৬ টন। কিন্তু এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সোনা অবৈধ পথে দেশে আসছে। পাঁচটি সোনার চালান এলে ধরা পড়ে মাত্র একটি। অবৈধ পথে দেশে নিয়ে আসা এসব সোনার একটি বড় অংশ চলে যায় পাশের দেশে। যে কারণে দেশে সোনা চোরাচালান কমছে না। সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুর রউফ বলেন, নতুন কৌশল হিসেবে ‘আনসিডিউল’ ফ্লাইটে সোনা আনা হচ্ছে, যাতে ধরা না পড়ে। আবার বড় চালানের ক্ষেত্রে ১০ জন মিলে বিনিয়োগ করে থাকেন। যাতে ধরা পড়লেও সবাই মিলে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে।
সিপি