‘বুধবার দুপুর তিনটায় সুপ্তি আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলছিলেন। এ সময় ৩০ বছরের কাছাকাছি বয়সের এক যুবক আসার পর সুপ্তি আমাকে বলল উনি তার আঙ্কেল। আঙ্কেল ভাত খেতে এসেছেন, দুপুর ১২টায় এসে একবার বলে গিয়েছেন লাঞ্চ আমার বাসায় করবেন।’
বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) দুপুরে নাসিমা মঞ্জিলের ভাড়াটিয়া ও খুন হওয়া সুপ্তি মল্লিকের প্রতিবেশী ফাতেমা পারভীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এমনই তথ্য জানালেন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির পাশাপাশি ফাতেমা পারভীনের দেওয়া এই তথ্যও সুপ্তির খুনিকে ধরিয়ে দিতে সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ফাতেমা পারভীন আরও বলেন, ‘তিনটার দিকে সে তার আঙ্কেলকে ভাত খাওয়ানোর জন্য যখন তার রুমে যাচ্ছিল তখন ডেকে আমাকে চা খাওয়াতে বলছিল। আমার মেয়ে চা বানিয়ে দিয়েছিল, আমি তাকে ডেকে দুই কাপ চা দিয়েছিলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে যখন তার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না তখন দরজায় বাড়ি দিলাম। দরজার বাইরে ঝুলানো পর্দা সরিয়ে দেখি বাইরে থেকে দরজাটি বন্ধ। তখন সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে তার নাম ধরে কয়েকবার ডেকেও কোনো জবাব পাইনি। এরপর পাশের বাসার ভাবী দরজার ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে দেখেন ভিতরে তার জুতা। তখন আমাদের সন্দেহ হলো, তার জুতা ভিতরে কিন্তু দরজা বাইরব থেকে বন্ধ কেন? আমরা অফিসে জানালে অফিস থেকে বাসার দারোয়ান ইলিয়াস আসেন।’
নাসিমা মঞ্জিলের দারোয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘আমি মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য ছোট মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে ভবনের ইনচার্জ আজিজ সাহেবের ফোন পেয়ে চার তলায় গিয়ে দেখি ভাড়াটিয়া সুপ্তি মল্লিকের বাসার সামনে অন্যান্য মহিলাদের জটলা। ৫০ নম্বর রুমের বাসিন্দা ফাতেমাসহ দুইজনকে সুপ্তিদের বাসায় যেতে বলি। মহিলারা সুপ্তির গায়ে হাত দিয়ে মারা গেছে বলে ধারণা করেন। এরপর আমরা থানায় কল করলে পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধা করার পাশাপাশি আলামত সংগ্রহ করেন।’
প্রসঙ্গত, চারতলা বিশিষ্ট নাসিমা মঞ্জিলে মোট ৬০ পরিবারের বসবাস। কিন্তু ওই ভবনসহ আশপাশের কোনো ভবনেই সিসি ক্যামেরার কোনো ব্যবস্থা নেই। সুপ্তি মল্লিকের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর প্রশাসনের চাপে বাড়ির মালিকরা সিসি ক্যামেরা লাগাচ্ছেন।
ডবলমুরিং থানা সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে সুপ্তি মল্লিককে গলা টিপে হত্যার আলামত পেয়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুপ্তি মল্লিকের স্বামী বাসু দেব ও তার বড় ভাই অনুপম চৌধুরীকে ডবলমুরিং থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাসু দেব একটি ফার্মেসিতে এবং তার ভাই সেলুনে কাজ করতেন। তাদের বাড়ি রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম বিভাগ) এসএম হুমায়ুন কবির চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে সুপ্তি মল্লিককে খুন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আশপাশে তথ্যের পাশাপাশি আমরা প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে আমরা সুপ্তি মল্লিকের খুনিকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুপ্তি মল্লিক যাকে আংকেল বলে প্রতিবেশীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ব্যক্তি কী আদৌ আঙ্কেল ছিলেন, নাকি আঙ্কেল পরিচয়ের আড়ালে অন্য পরিচয় আছে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই আঙ্কেল সুপ্তির ঘনিষ্ঠজন হতে পারেন, আবার স্বামী কিংবা অন্য কেউ তথাকথিত আঙ্কেলকে তার বাসায় পাঠাতেও পারেন।’
সুপ্তি মল্লিকের ছোট ভাই প্রসেনজিৎ মল্লিক জানান, আগস্টের ১৪ তারিখ তার বোনের সাথে বাসু দেবের বিয়ে হয়। বাসু দেবের বড় ভাই অনুপমের বউয়ের ছোট বোনের সাথে বাসু দেবের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি বিয়ের ১০ দিনের মাথায় সুপ্তির কাছে ধরা পড়ে। দুর্গাপূজার সময় সুপ্তি বাপের বাড়ি কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা গেলে বাসু দেব তার সেই তালতো বোনকে নিয়ে বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরতে দেখেছেন লোকজন।
বোনের সাথে কারও কোন সম্পর্ক ছিল কিনা জানতে চাইলে প্রসেনজিৎ বলেন, ‘আমার বোন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ার সময় এক মুসলিম যুবকের সাথে সম্পর্ক ছিল। দুই থেকে আড়াই বছর আগে সেই সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। আমরা বিয়ের আগে বাসু দেবকে তা জানিয়েছিলাম। তিনি সেটা কোন সমস্যা নাই বলে মেনেও নিয়েছিলেন।’
সুপ্তি মল্লিকের পিতা সাধন কুমার মল্লিক কর্ণফুলী পেপার মিলে চাকরি করতেন। ছয় বছর আগে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি জানান, পুলিশের কাছ থেকে মেয়ের লাশ বুঝে পেলে চট্টগ্রাম নগরীর অভয় মিত্র শ্মশানে দাহ করবেন।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ জানান, ‘আমরা আমাদের তদন্ত করছি। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করলে তা আমলে নেওয়া হবে। তদন্ত শেষে কে খুন করেছে, কেন খুন করেছে বিস্তারিত জানানো হবে।’
এর আগে ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ পানওয়ালা পাড়া থেকে বুধবার (৪ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে নাসিমা মনজিল থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এমএফও