চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের বিরুদ্ধে জমি বরাদ্দে অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও দু’বছরেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও ১২টি অভিযোগও তদন্তাধীন রয়েছে। এমনকি স্বয়ং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে দেয়। কিন্তু কমিটি গঠনের এক বছর পার হলেও কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়কও জানেন না তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে!
জানা গেছে, ২০২০ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব নেন খোরশেদ আলম সুজন। ১৮০ দিন দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হয়। দায়িত্বকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ সভায় বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
এরপর ২০২১ সালের ২২ মে সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র-২ ও বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর তিন সদস্য হলেন আইন কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন, নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব কুমার দাশ ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।
তবে কমিটিকে সরেজমিনে এই বিষয়ে তদন্ত করতে বলা হলেও প্রতিবেদন জমা দিতে কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। ওই সময় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার দুই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সিটি কর্পোরেশন।
সুজনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জমি বরাদ্দ দেওয়া ছাড়াও সুজনের বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ ওঠে। অভিযোগগুলো হলো কর্পোরেশনের নিজস্ব পাম্পের পরিবর্তে ব্যবসায়িক পার্টনার থেকে তেল কেনা। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনে তেল চুরির দায়ে একজনকে বরখাস্ত করে আবার ১২৬ দিনের মাথায় পুনঃনিয়োগ দেওয়া। ২৯ বছর ধরে কর্মরতসহ তিনজন সিনিয়র থাকার পরও ১০ বছরের অভিজ্ঞ একজনকে উপ-সহকারী থেকে সহকারী প্রকৌশলী করা, যা করা হয়েছে সুজনের মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে।
প্রভিশন পিরিয়ড শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আশিকুল ইসলাম নামে এক প্রকৌশলীকে পদোন্নতি দেওয়া, যার আগে সিনিয়র ছিলেন ছয়জন।
প্রধান হিসাবরক্ষক করার ক্ষেত্রেও অনিয়ম। অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তাকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া। সিটি কর্পোরেশনের টাকায় কেনা আসবাবপত্র নিজের বাসায় নিয়ে যাওয়া। একইসঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের জায়গা ও দোকান স্ত্রী নামে বরাদ্দ এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নামেও দোকান ও জায়গা বরাদ্দ দেন সাবেক প্রশাসক সুজন।
এছাড়া অবৈধভাবে চারজনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ। বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগ এবং দরপত্র ছাড়া দোকান দেওয়ার বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগও ওঠে সাবেক প্রশাসক সুজনের বিরুদ্ধে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র-২ ও বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কবে দিয়েছি, তা আমার মনে নেই। এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’
তদন্ত প্রতিবেদন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দায়িত্ব পালনের সময় স্বল্পমেয়াদে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১২ ভাগে ১৭ হাজার ১৮৮ বর্গফুট করে জমি ১০ জনের কাছে ইজারা দেন। এতে প্রতি বর্গফুট জমি সর্বনিম্ন ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৮৫০ টাকায় মাসিক ভাড়া ধার্য করা হয়। এর মধ্যে তদন্তে গিয়ে বেশিরভাগ জমি বরাদ্দে অনিয়ম পাওয়া গেছে।’
অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অখ্যাত পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জমি বরাদ্দ দিয়েছেন সাবেক প্রশাসক সুজন। এছাড়া দরপত্র ছাড়াই আবেদনের ভিত্তিতে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তখন।’
এদিকে সিটি কর্পোরেশনের ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্তের পর ২০২২ সালের ২৪ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকীকে আহ্বায়ক করে একই বিভাগের উপ-সচিব (সিটি কর্পোরেশন-২) মো. জহিরুল ইসলামকে সদস্য সচিব ও যুগ্ম সচিব (পলিসি সাপোর্ট অধিশাখা) নুমেরী জামানকে সদস্য করা হয়।
এসব অভিযোগ তদন্তের অগ্রগতি জানতে কথা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে কিছু জানাতে পারছি না, এটি তদন্তাধীন বিষয়। এছাড়া এই বিষয়টি আমার মনেও নেই।’
ডিজে