সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে তাদের দুনিয়াটাই এখন ঝাপসা, চোখের কর্নিয়া গেছে বেশিরভাগেরই

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়ে যাদের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর ফলে চোখে ঝাপসা দেখছেন আগুনে পোড়া রোগীরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০ নম্বর চক্ষু ওয়ার্ডে ঘটনার পর মোট ৬৩ জন রোগী ভর্তি হলেও এখন সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। এর মধ্যে ৫ জনকে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রতিদিনই ২ থেকে ৩ জন রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে।

চিকিৎসক বলছেন, সীতাকুণ্ডের ঘটনায় আগুনেপোড়া রোগীদের চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এটি সারতে সময় লাগবে। তবে ওষুধপত্র দিয়ে সব বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। তবে ঝাপসা চোখ নিয়ে বাড়ি ফেরার পাশাপাশি জীবন ও জীবিকা শঙ্কাটাই মনে দানা বেধেছে তাদের। চোখের মত ওদের জীবনও জীবিকার দুনিয়াটাও সবমিলিয়ে এখন ঝাপসা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মোহাম্মদুল হক মেজবাহ বলেন, ‘আগুনে পোড়া রোগীদের কম-বেশি কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ওরা দূরের জিনিস ঝাপসা দেখছে। ঘোলা দেখছে। আমরা চোখের মনি বড় করার জন্য ওষুধ দিচ্ছি। মনি বড় হলেই এ সমস্যাটা আশা করি আর থাকবে না। তবে তাতে সময় লাগবে। কারন অগ্নিকাণ্ডে চোখে যে কেমিক্যালের ছিটা লেগেছে, তা মুছে যেতেও সময় লাগবে। তাই আমরা রোগীকে ওষুধপত্র ও চোখের ড্রপ ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের ওই দুর্ঘটনায় মোহাম্মদ মোরশেদ (৩৫) নামে এক যুবকের বাঁ চোখ ফেটে যায়। ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিনি। হাসপাতালের ২০ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

গত ৭ জুন মোরশেদসহ পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই পাঁচজন হলেন— সাইদুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইসমাইল, জসিম উদ্দিন ও মঈন উদ্দিন। তাদের সবার কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত ৭ জুন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আগুনে পোড়া রোগীদের দেখার পর ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, ‘চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগীকে আমি দেখেছি। তারা কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছেন। এখানে কয়েকজন রোগী রয়েছেন, যাদের চোখে বেশি ক্ষতি হয়েছে। আবার কয়েকজন রোগী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত পেয়েছেন, তারাও কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছেন।’

এদিকে পোড়া শরীরের সাথে চোখের কর্নিয়া সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরা রোগীরা জীবন ও জীবিকার শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। ছাড়পত্র পাওয়া রোগীদের ৫-৭দিন পর এসে ওয়ার্ডে এসে ডাক্তারকে দেখাতে বলা হয়েছে।

২০ নং ওয়ার্ডে কালো চশমা চোখে দিয়ে বেডের ওপর বসে ছিলেন বদরুল খান। ছিলেন আইসিডি কন্টেইনার ডিপোর সুপারভাইজার। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। সব ঝাপসা লাগে। দূরের জিনিষও কাছের জিনিষ দেখতে পান না বদরুল।

ইয়াছিন আরাফাত ছিলেন ডিপোর গাড়িচালক। বাড়ি নোয়াখালী। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর চোখে তিনি ঝাপসা দেখছেন। তার পাশের সিটে শোয়া সালাউদ্দিনও বলেন, তিনিও চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। মুখের পাশে কালো পোড়া দাগ। জানতে চান, তিনি কবে ছাড়া পাবেন হাসপাতাল থেকে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রী বললেন, ‘আমার স্বামীর টাকায় সংসার চলত। এখন আমার স্বামী চোখে ঝাপসা দেখে। কিভাবে সে আর কাজ করবে? সংসার চালাবে? ঝাপসা চোখের মত আমাদের জীবনও ঝাপসা হয়ে গেল।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৬ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭ জন। এদেরই একজন নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁওয়ের হযরত আলী (২৮)। ঘটনার দিন ডিপোর ভিতরে কোয়ার্টারে ছিলেন হযরত আলী। কন্টেইনার বিস্ফোরণের পর তিনি দৌড়ে গেটের দিকে এসে দেখেন গেট বন্ধ। আগুনের ছিটা তার শরীরে লাগে। তার হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।

বাঁশখালীর মিনহাজ গাড়ির হেলপার। ডিপো থেকে কালেকশান তুলে নেওয়ার জন্য ডিপোতে যান ঘটনার দিন রাতে। গিয়েই আগুনের মধ্যে পড়ে যান তিনি। পা ভেঙে যায় তার। আগুনেপোড়া হৃদয়ের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। চিকিৎসাধীন মারুফ হোসেনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে মঙ্গলবার (১৪ জুন) সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ২৪ নং ওয়ার্ডে ৭ জন, ২৬ নং ওয়ার্ডে ৭ জন, ৩৬ এ ১৪ জন, ২৮ এ ১ জন, ২৫ ১ জন, ২০ এ আছে ১০ জন, ৩৫ এ আছে ১ জন, ১৯ এ আছে ১ জন সহ মোট ৪২ জন বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ চিকিৎসাধীন রোগী ভর্তি আছে।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!