সন্ধানী চোখ নিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ঘুরে বেড়াবে ৪ কোটি টাকার ‘তরী’

গবেষণা তরী বদলে দেবে ১৯ হাজার জেলে পরিবারের জীবন

রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদের ‘প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য’ নিয়ে গবেষণায় সিভাসু রিসার্চ ভ্যাসেল (গবেষণা তরী) বদলে দেবে প্রায় ১৯ হাজার জেলে পরিবারের জীবনযাত্রা। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)’র উদ্যোগে নির্মিত এই গবেষণা তরীটি ৬৮ হাজার হেক্টর আয়তনের হ্রদে চলাচল করবে। এ জাহাজের মাধ্যমে হ্রদের মাছ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান ও সংরক্ষণে নানা পরিকল্পনা, উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি সিভাসুর এমএস ও পিএইচডি লেভেলের শিক্ষার্থীরাও সারা বছর এতে গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারবেন।

কাপ্তাই হ্রদের ‘প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য’ এবং সম্পদ নিয়ে গবেষণার জন্য নির্মিত বিশেষায়িত নৌযান ‘সিভাসু গবেষণা তরী’ বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সকালে গণভবন থেকে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একে এম মামুনুর রশিদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, রাঙ্গামাটি জেলায় জেলে পরিবারের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার। রাঙ্গামাটি জেলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকার উৎস কাপ্তাই হ্রদের মাছ। কিন্তু মানুষ্য সৃষ্ট কারণ সহ নানা কারণে এ হ্রদের প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

সিভাসু সূত্রে জানা যায়, এ হ্রদের মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণসহ মাছ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাণী ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে সিভাসুর গবেষণা তরী। এ তরীতে প্রায় ১৫টি বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ হবে। গবেষণার অন্যতম বিষয়গুলো হলো মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য স্থান নির্বাচন, বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতি পুরুদ্ধার, হ্রদের চাষযোগ্য সম্ভাব্য প্রজাতি বের করা, বিভিন্ন মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার কারণ অনুসন্ধানসহ মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য সৃষ্টি করা।

জলবিদ্যুৎ নির্মাণের জন্য কর্নফুলী নদীর প্রবাহে বাঁধ দেয়ার কারণে ১৯৫৬ সালে ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জলায়তনের বিশাল এই জলাধারটি সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন, নৌ যোগাযোগ, জলেভাসা জমিতে কৃষি চাষাবাদ, সেচ, ব্যবহার্য পানি সরবরাহ, পর্যটনসহ বিভিন্ন সুযোগ ও সম্ভাবনা গড়ে ওঠে কাপ্তাই হ্রদ প্রকল্পকে ঘিরে।

কিন্তু দীর্ঘ ৫৯ বছরে একবারও কাপ্তাই হ্রদের কোনো সংস্কার, ড্রেজিং বা খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদে পলি জমে আর নিক্ষেপ করা হাজার হাজার টন বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হ্রদের তলদেশ। এতে নাব্যতা কমে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই কৃত্রিম জলাশয়।

সময়ের বিবর্তনে হ্রদের বৈশিষ্ট্যও নষ্ট হতে থাকে। ৮০টির মধ্যে ৬২টিই দেশি মাছের প্রজাতির বিপন্ন হয়েছে এরই মধ্যে। দেশের মিঠা পানির আমিষের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা কাপ্তাই লেকের তলদেশ পলি ভরাট, অবৈধ দখলসহ, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুষণে এখনকার জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। হারাতে বসেছে তার স্বকীয়তা।

এসব বিষয় বিবেচনা করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) গবেষণার জন্য ‘সিভাসু রিসার্চ ভ্যাসেল’ ভাসানোর উদ্যোগ নেয়। হাত বাড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই গবেষণা প্রকল্পে। রাঙামাটির পুরাতন হেলিপ্যাড এলাকায় নারায়ণগঞ্জের একটি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করে। নির্মাণের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে কাপ্তাই হ্রদে পরীক্ষামূলকভাবে ভাসানো হয় জাহাজটি।

যেসব বিষয়ে গবেষণা হবে: গবেষণা তরীতে ১৫টি বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ করা হবে। এর মধ্যে লেকের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের হার বের করা, মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য স্থান নির্বাচন করা, সময়ের সঙ্গে লেকের বিভিন্ন ভৌত রাসায়নিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা, বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতি বের করা, বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা নিরুপন, প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা, স্থানীয় জনশক্তিকে খাঁচায় ও পেন কালচারের মাধ্যমে মাছ চাষে উদ্যোগী করা, ঘোনায় মাছ চাষের সুবিধা-অসুবিধা যাচাই করা, লেকের মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের বিস্তৃতির বর্তমান অবস্থা নিরুপন, প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে করণীয় নির্ধারণ, লেক ভরাট হওয়ার কারণ উৎঘাটন-বিশ্লেষণ ও নিরুপণে উদ্যোগ এবং লেকের দূষণ দূরকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা বিষয়ে গবেষণার কাজ করবে জাহাজটি।

আয়তনের হিসেবে হ্রদটি থেকে বছরে এক থেকে দেড় লাখ টন মাছ পাওয়ার কথা। কিন্তু মাছের প্রজাতি ব্যাপক হারে বিলুপ্ত হওয়ায় বর্তমানে মাত্র ১০-১৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তাই বিলুপ্ত প্রজাতি ফিরিয়ে আনা ও মাছের প্রজনন বৃদ্ধি করে এই হ্রদকে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে এই গবেষণা তরী চালু করা হয়েছে।

জাহাজটির তত্ত্বাবধায়ক সিভাসুর উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, এই তরী ১৫ ধরনের কাজ করতে পারবে। তবে বার্নিং ইস্যু সামনে চলে আসলে সেগুলোও গবেষণা হবে এখানে।

সিভাসুর মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এম নুরুল আবছার খান বলেন, ‘আধুনিক ল্যাবসমৃদ্ধ এই তরীর মাধ্যমে সিভাসুর এমএস ও পিএইচডি লেভেলের শিক্ষার্থীরা সারা বছর গবেষণা চালাতে পারবেন।’

সিভাসুর ফিশারিজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ড. শেখ আহমাদ-আল-নাহিদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গবেষণা তরীর কারণে রাঙ্গামাটি এলাকায় মৎস্য উৎপাদন ১০ গুণ বেড়ে যাবে। যার সুফল সারা দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।’

গবেষণা তরীটি তৈরির মূখ্য উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়া মাছের জাত ফিরিয়ে আনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি ফিরিয়ে আনাসহ মাছের সফল প্রজনন প্রক্রিয়া জানার মাধ্যমে ফিরে আসবে আগের সুদিন।’

সিভাসুর উপ পরিচালক (জনসংযোগ) খলিলুর রহমান বলেন, ‘মালয়েশিয়া তাদের কৃত্রিম হ্রদ ‘লেক কেনিয়র’ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা পরিচালনা করে। পরবর্তীতে তারা এই লেকে বিপন্ন প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। সেই হ্রদের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে কাপ্তাই লেকে নামানো হয়েছে সিভাসু গবেষণা তরী।’

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!