সিটি কর্পোরেশনের ‘বিতর্কিত’ দুই প্রকৌশলীকে ফিরিয়ে আনার নতুন ছক
ছাত্র আন্দোলনে সড়কের বাতি নিভিয়ে বদলি হন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বদলি করা তিন প্রকৌশলীর দু’জনকে আবার ফেরাতে তৎপর হয়ে ওঠেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এনিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও ইস্যু করা হয়েছে। ‘উন্নয়নের প্রয়োজনে’ তাদের ফেরানোর আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
দু’জনকে ফেরাতে সোমবার (১৮ নভেম্বর) ওই চিঠিতে ৫ হাজার ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জিওবি অর্থায়নে ৪টি এবং বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়নে ১টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠু বাস্তবায়নের যুক্তি দেখানো হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাবেক মেয়র রেজাউল করিমের নির্দেশে টানা তিনদিন সন্ধ্যায় আন্দোলনস্থলে লাইট বন্ধ রাখা হয়। একাজে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেম ও নির্বাহী প্রকৌশলী ঝুলন দাশের সঙ্গে সিইও শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামও সমান ‘অভিযুক্ত’ ছিলেন। আন্দোলন-পরবর্তী ছাত্ররা প্রধান প্রকৌশলী ও সিইওর পদত্যাগ দাবি করে। কিন্তু সে যাত্রায় বেঁচে যান সিইও তৌহিদুল। এখন সেই তৌহিদুলসহ মিলে বিতর্কিত দুই প্রকৌশলী শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেমকে স্বপদে ফেরানোর নতুন ছক আঁকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশন থেকে চিঠি ইস্যু হওয়ার কথা শুনেছেন জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালে মেয়রের নির্দেশে প্রকৌশলী শাহীন উল ইসলাম ও ঝুলনরা লাইট বন্ধ রাখাসহ নানামুখি ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। তাই আন্দোলন-পরবর্তী ছাত্রদের দাবির মুখে সরকার তাদের বদলি করেছিল। এখন বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের দোসরদের পুনর্বাসন করতে নানা মহল থেকে ষড়যন্ত্র চলছে। দুই প্রকৌশলীকে সপদে ফেরানোর চেষ্টা তারই অংশ।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সিটি কর্পোরেশনের ‘উন্নয়নের প্রয়োজনে’ দুই প্রকৌশলীকে সপদে ফেরানোর আবেদন করা হয়েছে বলে জানান, সিইও শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তবে বদলি করা বা না করা, মন্ত্রণালয়ের বিষয় বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, আন্দোলন-পরবর্তী ১৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনের সিইও বরাবরে একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে ৩, ৪ এবং ৫ আগস্ট ছাত্রদের আন্দোলনের সময় সড়কের লাইট বন্ধ রাখা ও বিভিন্ন টেন্ডারে দুর্নীতির তদন্ত এবং বিধি বহির্ভূত নিয়োগকৃতদের বহিষ্কারসহ ৯টি দাবি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। ওই দাবিনামায় আন্দোলনকারীদের পক্ষে মো. সাদমান ইসলাম, তপুসহ ৫ জন স্বাক্ষর করেন।
পরদিন ১৪ আগস্ট ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ’ শিরোনামে ১৬টি দাবি আদায়ে সিইও দপ্তরে আরও একটি আবেদন জমা পড়ে। এতে স্বাক্ষর করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, চবি সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান, সমন্বয়ক ইয়াছির আরফিন, সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল মাহাথির ও ফজলুল হক (সাবান)।
ছাত্রদের দাবি বিবেচনায়, ২৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের এক অফিস আদেশে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহীন উল ইসলাম চৌধুরীকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে, নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশকে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে এবং আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেমকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে বদলি করা হয়। ওই তিন প্রকৌশলী তাদের বদলি করা কর্মস্থলে যোগদানও করেন। এছাড়াও মোহাম্মদ শাহীন উল ইসলাম চৌধুরীর পদে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে যোগ দেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম।
এর মধ্যে ১৮ নভেম্বর হঠাৎ বদলিকৃত দুই প্রকৌশলী মো. শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেমকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বদলি করতে মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি ইস্যু করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সিইও শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সিইও শেখ মুহাম্মদ তৈহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘সিটি মেয়রের সঙ্গে আলাপ করে, কর্পোরেশনের প্রয়োজনে দুই প্রকৌশলীকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বদলির আবেদন করা হয়েছে। তিন প্রকৌশলীকে বদলি করা হলেও তদন্তে প্রকৌশলী মো. শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেমের কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আমরা আবেদন করেছি, আবেদন গ্রহণ করা না করা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’
দুই প্রকৌশলীর বদলির আবেদনে ‘লেনদেন’ ও আওয়ামী সরকারের দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুই প্রকৌশলীকে বদলির বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়কেরও সুপারিশ রয়েছে।’
কোন সমন্বয়কের সুপারিশ রয়েছে, জানতে চাইলে ফাইল দেখতে হবে বলে জানান তৌহিদুল ইসলাম।
এরপর সুপারিশ করা সমন্বয়কের নাম প্রতিবেদক বার বার জানতে চাইলে এক পর্যায়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপে সমন্বয়কের নাম জানতে ক্ষুদেবার্তা দেওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।
এদিকে দুই প্রকৌশলীকে ফেরাতে সমন্বয়কের সুপারিশ আছে কিনা, জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমার জানা মতে, দুই প্রকৌশলীকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বদলির বিষয়ে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তাদের জন্য কোন সমন্বয়ক সুপারিশ করেছে, তা আমাদের জানা দরকার।’
এ বিষয়ে জানতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির মুঠোফোনে একাধিকবার যোগযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি প্রতিবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এসব বিষয় জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রকৌশলী মো. শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী ফোন কল রিসিভ করেননি। তবে আরেক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাশেম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে মন্ত্রণালয় থেকে নারয়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে বদলি করা হয়েছে। বদলির কারণ না জানলেও আমি বর্তমানে নারয়ণগঞ্জে কর্মরত আছি। এখন চট্টগ্রামে পুনঃবদলির আবেদন বা সমন্বয়কের সুপারিশের যে বিষয় বলছেন, তাও আপনার কাছ থেকে শুনলাম। বিষয়টি ওনারাই ভালো বলতে পারবেন। আর টাকা লেনদেনের যে বিষয়টি বলছেন, এসবের মধ্যে আমি নেই। যে কয়দিন চাকরি করেছি, সৎ থাকার চেষ্টা করেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদত হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনিও সংযোগ কেটে দেন।
ডিজে