সিএসসিআরে মেমোগ্রাফির বদলে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে রোগী বিদায়!
মেমোগ্রাফির মেশিনই নেই, তবু লোভ ১২০০ টাকার
হাসপাতালে মেশিনই নেই, অথচ ‘রোগ নির্ণয়’ করে রিপোর্ট সরবরাহ করছে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআর। রোগীর চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) লেখা আছে মেমোগ্রাফি পরীক্ষার কথা। কিন্তু মেমোগ্রাফি বা মেমোগ্রাম পরীক্ষা করানোর কোনো মেশিনই তাদের নেই। তাই সচেতনভাবেই ব্যবস্থাপত্রের নির্দেশ এড়িয়ে সিএসসিআর কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করালো আল্ট্রাসনোগ্রাফি। পরীক্ষা বাবদ নেওয়া হল ১২০০ টাকা। রোগীর পরিবার এমন ভুলের কারণ জানতে চাইলে ‘রোগীর ভুল’ বলে দোষ চাপিয়ে সিএসসিআর কর্তৃপক্ষ উল্টো দুর্ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আর এমন জালিয়াতির ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া মধ্যম কাঞ্চনার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে।
জানা যায়, ৪০ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন স্তনের টিউমারজনিত সমস্যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ মতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাঝে কিছুদিন সুস্থ ছিলেন। আবারও অসুস্থতা বোধ করায় ২১ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়া থেকে ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগে। বহির্বিভাগের চিকিৎসক ‘স্তন ক্যান্সার আছে কি না’ তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেমোগ্রাফি পরীক্ষায় কথা ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন। চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নগরীর পাঁচলাইশে বেসরকারি হাসপাতাল এপিক হেলথ কেয়ারে যান।
সেখানে মেমোগ্রাফি পরীক্ষার ফি ২৫০০ টাকা হওয়ায় আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরে যান মনোয়ারা বেগম। ব্যবস্থাপত্র দেখানোর পর রিসিপশনে থাকা কর্মী সেটি না বোঝায় অন্য কক্ষে থাকা একজনের সঙ্গে পরামর্শ করে মনোয়ারা বেগমকে জানান ১২০০ টাকা লাগবে এই পরীক্ষা করাতে। এদিকে মনোয়ারা বেগম এপিক হেলথ কেয়ারের চেয়ে সিএসসিআরে পরীক্ষার ফি কম হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেন সিএসসিআর হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে। তিন ঘন্টা অপেক্ষা করে এন্ট্রি করিয়ে পরীক্ষা করানো হয় মনোয়ারা বেগমের।
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এন্ট্রি করিয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি। মেমোগ্রাফি পরীক্ষার ব্যবস্থা সেখানে নেই। আল্ট্রাসনোগ্রাফির চিকিৎসক মনোয়ারাকে টেস্ট করানোর সময় প্রেসক্রিপশন এবং হাসপাতালের এন্ট্রি দুটিই নেন। প্রেসক্রিপশনের টেস্টের সঙ্গে হাসপাতালের এন্ট্রির মিল না থাকার পরও তিনি ঠিকই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে ফেলেন। ভুক্তভোগী মনোয়ারা বেগম ইংরেজি লেখা তেমন না বোঝায় তিনি এর কিছুই আঁচ করতে পারেননি।

পর দিন ২২ সেপ্টেম্বর সকালে ডা. রেহনুমা রশীদ স্বাক্ষরিত আল্ট্রাসনোগ্রাফির সেই রিপোর্ট নিয়ে আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক ওষুধ দিতে অক্ষমতা জানিয়ে মনোয়ারা বেগমকে বলেন, ‘আপনাকে বললাম মেমোগ্রাফি করার জন্য। আপনি করিয়ে এসেছেন আল্ট্রাসনোগ্রাফি! আপনাকে কেমনে মেডিসিন দেবো?’
এমন ঘটনার পর ভুক্তভোগী মনোয়ারা বেগমের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত সিএসসিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে। তারা একে ‘রোগীর ভুল’ বলে সাব্যস্ত করে।
ভুক্তভোগীর ছেলে ইয়াছিন আরাফাত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে তাদের জানালে তারা তাদের দোষ তো স্বীকার করলোই না, উল্টো আমার ওপর দোষ আরোপ করলো। আমাকে ধমক দিয়ে তারা বলল, এটা নাকি আম্মুর ভুল! কিন্তু কেমন ভুল সেটা আর তারা এক্সপ্লেইন করতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন,’ এরই মধ্যে আমাকে সিএসসিআর থেকে টাকা রিটার্ন করবে বলে কল দিয়ে দুবার নিয়ে গিয়ে হয়রানি করে। আমি অসহায়! আমি অসহায় তাদের যুক্তিতে।’
ভুক্তভোগী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এতো দূর থেকে এসে পরীক্ষা করালাম রোগ ধরা পড়ার জন্য। কিন্তু এরা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) জেনেশুনে এমন জালিয়াতি করলে আমরা কোথায় যাবো? এপিকে টাকা বেশি বলে এখানে এলাম। না থাকলে বলে দিতো। আমরা কি জোর করেছিলাম?’
মনোয়ারা বেগম আরও বলেন, ‘শেভরন হাসপাতালে ৩২০০ টাকা, এপিকে ২৫০০ টাকা বলার পর মেট্রোতে গেলাম। কিন্তু তাদের কাছে নাই এবং তারা পারবে না আমাদের জানিয়েছিল। এরপর সিএসসিআরে গেলাম তারা ১২০০ বলায় সেখানেই করলাম। অথচ আমার কিছুই হলো না। টাকা তো গেলই সাথে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে আমার ওপর!’
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, মেমোগ্রাফি করানোর উদ্দেশ্যেই হচ্ছে স্তন ক্যান্সার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে যাদের একটি বিশেষ জিন মিউটেশনের শিকার হয়, তাদের এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। তবে সময়মতো মেমোগ্রাফি করানো হলে মৃত্যুর ঝুঁকি খানিকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেমোগ্রাম করতে আসা প্রতি ৩৬৮ জনের মধ্যে অন্তত একজনের জীবন এই পরীক্ষার কারণে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এভাবে স্তন ক্যানসারে মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনা গেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে মঙ্গলবার এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সিপি