সিএমপি/ বহু ঘটনা, বিস্তর মামলা—৬ মাসে তবু অস্ত্র উদ্ধার ৯৫!

নগরীতে বিভিন্ন সময় ব্যবহার হয় আগ্নেয়াস্ত্র। কখনো অবৈধ অস্ত্র, আবার কখনো বৈধ অস্ত্র কিন্তু অবৈধভাবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নগরীর ১৬টি থানা ও নগর পুলিশের বিভিন্ন বিশেষ টিম মিলে উদ্ধার করেছে মাত্র ৯৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। গত বছর একই সময়ে উদ্ধার হয়েছিল ৬৬টি আগ্নেয়াস্ত্র।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন উদাহরণও আছে। গুলিতে গৃহবধু নিহত হওয়ার পাঁচঘন্টার মাথায় অভিযুক্ত আসামির লাশ উদ্ধার হয়েছে বাকলিয়ার বলিরহাট এলাকায়। রসুলবাগ আবাসিক এলাকায় যুবলীগ কর্মী এইচএম লোকমান হোসেন রনি হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্ত সাইফুলকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল নিহত হন। উদ্ধার হয়েছিল রনিকে হত্যায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র।

বছরের প্রথম ছয় মাসে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মাঝে রয়েছে বিদেশী পিস্তল ১১টি, একনলা বন্দুক নয়টি, পাইপগান ১১টি, এলজি ৫০টি, শুটারগান পাঁচটি, শটগান একটি, এসএমজি একটি, দুনলা বন্দুক একটি, দেশী বন্দুক চারটি, কাটা রাইফেল একটি, দেশী পিস্তল একটি, ম্যাগাজিন ১১টি, গুলি ১৭৩ রাউন্ড, কার্তুজ ১৫৮ রাউন্ড। এসব অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ৩৪২টি মামলার বিপরীতে আসামি হয়েছে ৫৭৮ জন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৫ জানুয়ারি রাতে নগরের চন্দনপুরায় ছাত্রলীগ কর্মী জাহেদুল ইসলামের পায়ে গুলি করা হয়। এই অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফসহ তার তিন সহযোগী আটক হয়েছিলেন। কিন্তু যে পিস্তল থেকে গুলি করা হয়েছে সেই পিস্তলের কোন হদিস করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ ব্যাপারে চকবাজার থানার ওসি মো. নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, জাহেদুল ইসলামের ওপর গুলি করার অভিযোগে মামলা হওয়ার পর আসামিদের ৪ জনকে গ্রেফতার করে আমরা আদালতে সোপর্দ করেছিলাম।
তবে কোন অস্ত্র উদ্ধার হয়নি বলে স্বীকার করেন ওসি।

২ মার্চ নগরের শুলকবহর এলাকায় দিদার নামের এক সন্ত্রাসী দলবল নিয়ে এক আবাসন কোম্পানির কর্মকর্তাকে অস্ত্র উঁচিয়ে চাঁদা দাবি করে। ওই কর্মকর্তা ‘জীবন সংকটাপন্ন’ উল্লেখ করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ দিদারকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। কিন্তু এক্ষেত্রেও কোন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।

গেল বছর দফায় দফায় চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার সচিত্র ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও উদ্ধার হয়নি কোন অস্ত্র।

১৫ জানুয়ারি ২০১৮ নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসফার হত্যাকাণ্ডের সময় প্রদর্শিত হয়েছিল ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র। আদনানকে আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে ধাওয়া করে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়। ধাওয়াকারী দুই যুবকের একজনের হাতে ছিল পিস্তল, অন্যজন ছুরি হাতে আদনানকে আঘাত করে। আদনান তৎকালীন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীর নাতি।

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তিনটি মোটরসাইকেলযোগে ১০ জনের টিম জিইসি মোড় থেকে মুরাদপুরের দিকে যাওয়ার সময় ষোলশহর দুই নম্বর গেইটে তাদের দাঁড়ানোর সংকেত দেয় পুলিশ। অস্ত্রসহ ধরা পড়ার আগেই তাদের বহন করা অস্ত্র থেকে পুলিশের ওপর গুলি করা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারলেও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। উদ্ধার হয়েছিল কেবল গুলির খোসা!

২৭ এপ্রিল ২০১৮ বাকলিয়া এলাকায় ডিস ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিজ দলের ক্যাডারদের গুলিতে খুন হন যুবলীগ কর্মী ফরিদুল ইসলাম। ফরিদের অধীনে প্রায় পাঁচ শতাধিক ডিসের লাইন ছিল। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বিভিন্ন সময় আটক করলেও অস্ত্রগুলো থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ সিসি ক্যামেরার ফুটেজে স্পষ্ট ছিল গুলি করার দৃশ্য।

নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যা করার পর সন্ত্রাসীরা নালাপাড়া এলাকা ছাড়ার সময় ফাঁকা গুলি করে আতংক সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তরা ছাড়াও নির্দেশদাতাকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও কোন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার নেই। সুদীপ্ত হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে ২৯ জুলাইয়ের সংঘর্ষে নিজের লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র থেকে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি করার অভিযোগ আছে। ওই ঘটনায় সর্বমোট ২২ জন গ্রেপ্তার হলেও কোন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। ১ আগস্ট মাসুমের শটগান ও পিস্তলের লাইসেন্স বাতিল করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আলোচিত সিআরবি ডাবল মার্ডারে ব্যবহার হয়েছে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র। যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের অনুসারীদের মারামারিতে শিশু আরমান হোসেন টিটু ও যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগাভাগি নিয়ে সংঘটিত ওই ঘটনায় আটক-কারাভোগ-জামিন সবই হয়েছে, কিন্তু উদ্ধার হয়নি কোন অস্ত্র!

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালে নগর বিএনপি সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ানের নির্বাচনী কার্যালয় এবং গাড়িকে লক্ষ করে গুলি করা অভিযোগে তিনি মামলা দায়ের করেছিলেন। পুলিশ মামলা গ্রহণ করলেও থানায় রেকর্ড করেনি বলে তিনি অভিযোগ করেন। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুলির চিহ্নসহ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী তাদের নির্বাচনী গণসংযোগে অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করা হয়েছিল বলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন।

কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র নগরের সন্ত্রাসীদের হাতে আছে তার পরিসংখ্যান নেই খোদ নগর পুলিশের কাছেও। সম্প্রতি অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে পাঁচ হাজার অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে থাকার সংবাদের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংবাদটি সঠিক নয় বলেও দাবি করলেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা।

সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমি সিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়ার পর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে অথচ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি এমন ঘটনা নেই। প্রতিটি ঘটনায় অস্ত্র উদ্ধার আছে, আসামিও গ্রেপ্তার হয়েছে। আগের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!