সিআরবি ইস্যুতে নাছিরের পথেই হাঁটছেন চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতারা

জনমতে বিব্রত তৃণমূল সরকারের দিকে তাকিয়ে

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে শেষপর্যন্ত চট্টগ্রামের শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা একে একে হাঁটছেন আ জ ম নাছিরের পথেই। শুরুতে আ জ ম নাছির উদ্দিনই একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকেন। এ কারণে তিনি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হলেও মাত্র দেড় মাসের মাথায় তার পথেই হাঁটলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চাঁন্দগাও-বোয়ালখালী আসনের সাংসদ মোছলেম উদ্দিন। মোছলেম উদ্দিনের মন্তব্য নিয়ে যখন নগরে তুলকালাম চলছে, এর মধ্যেই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানালেন সরকারের একটি নির্বাহী দায়িত্বে থেকে সিআরবি ইস্যুতে মন্তব্য করা ‘সমীচীন’ মনে করেন না তিনি। আবার নওফেলের বক্তব্য সবাইকে পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে— এমন মন্তব্য করে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোছলেম উদ্দিন বলেছেন, আগে-পরে সবাইকে হাসপাতালের পক্ষেই দাঁড়াতে হবে।

সবমিলিয়ে সিআরবি ইস্যুতে চরম ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতিতে পড়েছেন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এদিকে এত আলোচনা-সমালোচনার পরেও চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের সাথে পরামর্শ না করা এবং আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ না থাকা নিয়ে হতাশা আর দুঃখবোধের কথাও জানিয়েছেন নেতারা।

সিআরবি ইস্যুতে গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের তিন ইউনিট— মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার শীর্ষ নেতারা একসাথে হাসপাতাল নির্মাণস্থল পরিদর্শন করতে যান।
সিআরবি ইস্যুতে গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের তিন ইউনিট— মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার শীর্ষ নেতারা একসাথে হাসপাতাল নির্মাণস্থল পরিদর্শন করতে যান।

সিআরবি ইস্যুতে গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের তিন ইউনিট— মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার শীর্ষ নেতারা একসাথে হাসপাতাল নির্মাণস্থল পরিদর্শন করতে যান। সেখানে সবাই পরবর্তীতে একযোগে মতামত জানানোর কথা বললেও একদিনের মাথায় হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মত করে কথা বলার সুযোগ নেই জানিয়ে সরকারের অবস্থানই নিজের অবস্থান বলে সরাসরি জানিয়ে দেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন। তবে ওই সময় চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার নেতারা একযোগে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধেই তাদের মতামত জানান। এমনকি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীও ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে পরিবেশগত ঝুঁকি আছে এমন কোনো সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নেবেন না জানিয়ে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধেই নিজের অবস্থান জানান দেন।

এর পর থেকে টানা দেড় মাস ধরে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে আন্দোলন করছেন চট্টগ্রামের নাগরিকদের অনেকেই। এর অগ্রভাগে যারা রয়েছেন তাদের বড় একটা অংশই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত নেতা ও সমর্থক।

তবে এই দীর্ঘসময়েও আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এর মধ্যেই মোছলেম উদ্দিন ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বক্তব্য হঠাৎ করেই বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি।

সোমবার (২৯ আগস্ট) চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৬ শয্যার এইচডিইউ উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে বলেন, ‘এটা সরকারের একটা নির্বাহী সিদ্ধান্ত, আমি যেহেতু সরকারের একটা নির্বাহী দায়িত্বে আছি। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করাটা সমীচীন হবে না। আমার যেহেতু সমীচীন হবে না…. আন্ডার ওথ অফ এজ এ মিনিস্টার, আমাদের তো কনফিডেনশিয়ালি ওথ আছে…এবং কালেকটিভ মিনিস্ট্রিয়াল রেসপনসিবিলিটি বা সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষায় যেটা বলে, রেসিডেনসিয়াল অব গভর্নমেন্ট। ইটজ দ্য রেসপনসিবিলিটি অব দা এনটায়ার ক্যাবিনেট। সে কারণে আমি এ বিষয়ে মন্তব্য এই মুহূর্তে করতে পারছি না।’

মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরেই এক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোছলেম উদ্দিন নিজের অবস্থানের পক্ষে বলেন, ‘আজকে নওফেলের (শিক্ষা উপমন্ত্রী) বক্তব্যের পরে চট্টগ্রামবাসী জ্ঞাত হয়ে যাবে। দেখবেন যে আরও অনেকে এটার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবে।’

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অবস্থান জানার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।

এর আগে শনিবার (২৮ আগস্ট) চট্টগ্রাম সম্মিলিত কর আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল স্থাপনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে ‘উদ্দেশ্যমূলক ও হীন স্বার্থের আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করে এই হাসপাতাল স্থাপনের বিরোধিতা কাম্য নয়— এমন মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চাঁন্দগাও-বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দীন আহমদ। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে জানিয়ে এর বিরোধিতা করা মানে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করা বলেও এ সময় মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা। এই বিরোধিতার পিছনে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ইন্ধন রয়েছে দাবি করে মোছলেম উদ্দিন আরও বলেন, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এভারকেয়ার, ইমপেরিয়াল, পার্কভিউসহ বিভিন্ন হাসপাতাল মালিকদের ইন্ধনে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছে যা কাম্য নয়।’

পরবর্তীতে সিআরবিতে শহীদ আবদুর রবের কবর প্রসঙ্গে মোছলেম উদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিআরবিতে শহীদ আবদুর রবের কোনো কবর নেই। আবদুর রব মারা গেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (চুয়েট)। ওখানেই তাকে দাফন করা হয়েছে। ওখানেই তার কবর আমরা জেয়ারত করেছি এবং শহীদ আবদুর রবের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি হল পর্যন্ত বানিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে তার কবর। এখন যদি কেউ কিছু মাটি এনে সিআরবিতে কিছু স্মারক বা অন্য কিছু বানায়, সেটি আমি বলতে পারবো না, আমি জানি না।’

অন্যদিকে এখন পর্যন্ত হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে খোলামেলাভাবে নিজের অবস্থান জানিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্য গোপন করে এই হাসপাতালের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস এখানে হাসপাতাল করলে সেটার কী নেতিবাচক ফলাফল হবে— তা জানলে প্রধানমন্ত্রী এই হাসপাতাল করতে দেবেন না। এই হাসপাতাল না হলেই বরং জনগণের কাছে সরকারের ইমেজ বাড়বে।’

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান আতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের একটা অবস্থান আছে। কিন্তু পাবলিকলি এটা নিয়ে কথা বলা মনে হয় না আমাদের উচিত হবে। এছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ইস্যুতে আমার কমিটির যিনি সভাপতি এম এ সালাম ভাই, উনার সিদ্ধান্তকেই ফলো করছি। জেলা রাজনীতিতে উনি প্রবীণ। আর এক্ষেত্রে উনার অবস্থান হচ্ছে সরকার ও দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করে তাদের মতামত জানা এবং স্থানীয় পর্যায়ের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রকে জানানো। তবে এই বিষয়ে পাবলিকলি কথা বলার পক্ষে আমরা না।’

তবে সিআরবি ইস্যুতে সরকার ও দলের শীর্ষ পর্যায়ের অবস্থান ও স্থানীয় জনমতের চাপে আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকটাই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই তিন ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মত একটা জায়গায় এতদিন ধরে একটা আন্দোলন হচ্ছে। অথচ আমাদের দল বা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আমাদের মতামতও জানতে চাওয়া হয়নি। এই বিষয়টা আসলে খুব দুঃখজনক।’

ওই নেতা বলেন, ‘এটা যেহেতু সরকারের উদ্যোগ, সেহেতু বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সুযোগ নেই আমাদের। এটা যেমন সত্য, তেমনি এখানকার মানুষের যে অবস্থান সেটা কেন্দ্রকে জানানোটাও আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আমাদের কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। না আমাদের সরকারের চাওয়া জানানো হয়েছে, না আমাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। ফলে আমরা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!