সিআরবি আন্দোলন হঠাৎ চুপসে পড়েছে, হাসপাতালের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে রেল

৪ বড় ‘জালিয়াতি’ ধরে রেলকে ঘায়েলের পরিকল্পনা আন্দোলনকারীদের

চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে ‘আন্দোলন’ চললেও সাম্প্রতিক সময়ে এই আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছে অনেকটাই। কর্মসূচিও চলছে অনেকটাই ঢিলেঢালাভাবে— নামমাত্র। এর পাশাপাশি শুরুর দিকে আন্দোলনে বেশ সক্রিয় থাকা নেতারাও ধীরে ধীরে একেবারেই চুপ হয়ে গেছেন এই ইস্যুতে। কেউ কেউ নিজেকে আড়াল করে নিয়েছেন কৌশলে। আন্দোলনে সম্পৃক্ত নেতাদের মধ্য থেকেই এখন এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে হতাশার কথা উঠে আসছে খোলামেলাভাবে। তবে আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে থাকা নেতারা বলছেন, তারা মূল লক্ষ্যেই আছেন।

গত বছরের জুলাই থেকে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বেশ কিছু সংগঠন। এই ‘আন্দোলনের’ মাঝেই গত বছরের ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের প্রকল্পটি ‘বঙ্গমাতা’র নামে করার অনুমতি দিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভার সিদ্ধান্ত গত ৫ ডিসেম্বর ট্রাস্ট থেকে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয় রেল সচিবকে। বেসরকারি ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা আবেদনে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা ‍মুজিব স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স’ নামকরণের এই অনুমতি পায়।

হাসপাতাল স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নামকরণের এই অনুমোদন থেকেই হাসপাতালের পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে হাসপাতাল প্রকল্পকে ঘিরে একটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া ও সিআরবির প্রবেশ পথে গেইট নির্মাণ নিয়ে রেলওয়েও অনেকটাই নিজেদের ‘শক্ত অবস্থান’ জানিয়ে দিয়েছে।

হাসপাতাল প্রকল্পকে ঘিরে একটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া ও সিআরবির প্রবেশ পথে গেইট নির্মাণ নিয়ে রেলওয়েও অনেকটাই নিজেদের ‘শক্ত অবস্থান’ জানিয়ে দিয়েছে।
হাসপাতাল প্রকল্পকে ঘিরে একটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া ও সিআরবির প্রবেশ পথে গেইট নির্মাণ নিয়ে রেলওয়েও অনেকটাই নিজেদের ‘শক্ত অবস্থান’ জানিয়ে দিয়েছে।

যদিও হাসপাতালবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা রেলওয়ের এই অবস্থানকে ‘ফাঁদ’ হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, এগুলো করে মূলত রেলওয়ে সেখানে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। যে ফাঁদে তারা পা দেবেন না। এক্ষেত্রে তাদের নীরবতা আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার জন্যই। ইতিমধ্যে রেলওয়ের চারটি বড় জালিয়াতি চিহ্নিত করা হয়েছে— এমন দাবিও করছেন তারা।

তবে কারণ যাই হোক, সিআরবির এই আন্দোলন থেকে হঠাৎ করে অনেকেরই দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ লুকাতে পারছেন না আন্দোলনে যুক্ত অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে একে ব্যঙ্গ করে এও বলছেন, ‘সাত আটজন ছাড়া সিআরবি রক্ষকরা শীতের কবলে পড়েছে!’ কেউবা আবার টিপ্পনী কাটছেন— ‘অনেকে নিজ নিজ ভাগ নিয়ে কেটে পড়েছেন।’

এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেনকে চেয়ারম্যান এবং এডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন বাবুলকে সদস্য সচিব করে ১০০১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে রাখা হয় সদ্যপ্রয়াত শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফি, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও রাজনীতিবিদ মফিজুর রহমান, খোরশেদ আলম সুজন, পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. ইদ্রিস আলী, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের চেয়ারম্যান প্রবীর কুমার সেন, স্থপতি আশিক ইমরান, মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুচ ও রাজনীতিবিদ মাজহারুল হক শাহকে।

তবে গত ডিসেম্বর থেকেই ঝিমিয়ে পড়া সিআরবির সাম্প্রতিক আন্দোলনের কর্মসূচিতে পরিচিতমুখদের মধ্যে এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে শুধু ডা. মাহফুজুর রহমানকেই। এর বাইরে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে কিছু তরুণ কর্মী মাঝে মাঝে সরব থাকছেন।

এদিকে রাজনৈতিক একটি সূত্র দাবি করেছে, সিআরবি আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতারা মূলত ধীরে ধীরে আন্দোলন থেকে সরে গেছেন দলের হাইকমান্ডের নির্দেশেই। শুরু থেকে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে হাসপাতাল স্থাপনের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ স্থানীয় অনেক শীর্ষ সারির নেতা। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শুরুতে সিআরবি আন্দোলনের পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করলেও পরে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় তাকে। শুরুতে বিরোধিতা করলেও পরে একইভাবে চুপ মেরে যান চট্টগ্রাম সিটির মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও।

হঠাৎ করে সিআরবির আন্দোলনের মূল নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব এডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন বাবুল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মসূচি কন্টিনিউ করবো। আমরা দুইভাবে এগোচ্ছি— একটা হলো আমরা মাঠের কর্মসূচিও রাখবো আর আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলন নিয়ে সংশয়ে থাকার কোনো অবকাশ নাই। আমরা দুইভাবে এগোবো। আমরা আবার এমন কোনো হঠকারিতাও করতে চাই না, যাতে যারা মাঠে অবস্থান করবো তারা বিপদে পড়ে যায়। আমরা চাচ্ছি অহিংস ও অরাজনৈতিকভাবে এই আন্দোলনটা এগিয়ে নিতে।’

এক্ষেত্রে আন্দোলনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় হাইকমান্ড থেকে কোন ‘প্রেসার’ নেই জানিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এই আইনজীবী বলেন, ‘আন্দোলন না করার জন্য দল থেকে আমাদের ওপর কোনো প্রেসার নাই। এগুলো যদি কেউ বলে তবে কেন বলছেন সেটা তারাই বলতে পারবেন। তবে আমরা যারা আন্দোলনে আছি আমাদের প্রতি কোনরকম কোন প্রেসার নাই।’

নাগরিক কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনের বিষয়ে দল থেকে আমাদের কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। যদি দল এই বিষয়ে অবস্থান জানতে চায়, তাহলে আমরাও আমাদের দলের কাছে জবাবদিহি করবো। আমরা চট্টগ্রামের মানুষের স্বার্থে এই আন্দোলন চালিয়ে নিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলন নিষ্ক্রিয় হয়েছে— এই কথাটাও ঠিক না। অনেকে অসুস্থ, বেগম মুশতারি শফী তো মারাই গেলেন। বাবুল ভাই করোনা আক্রান্ত। এর মধ্যে করোনার পরিস্থিতি যেহেতু একটু খারাপের দিকে সেহেতু সিনিয়রদের সেভাবে আসার সুযোগ কম। তবু ডা. মাহফুজ তো প্রতিদিন যাচ্ছেন। আমরাও কাল সবাই মিলে মিটিং করলাম। সুজন ভাই কালকেও কয়েকটা মিডিয়ায় নিজের অবস্থান জানিয়েছেন।’

উস্কানি দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে— মন্তব্য করে সেই ফাঁদে পা দিবেন না জানিয়ে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘এখন দেখুন রেলওয়ে একবার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে, আবার তিন দিকে গেইট তুলছে। এর মধ্যে একটা পক্ষ বলে যাচ্ছে আন্দোলন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এটা মূলত একটা উস্কানি। এরা চাচ্ছেই আমরা গিয়ে সেখানে বাধা দিই। একটা পরিস্থিতি তৈরি করে তারা আন্দোলনকে ঠেকিয়ে দিবে। আমরা তো এই ফাঁদে পা দেবো না। তবে এটাও ঠিক, চূড়ান্তভাবে বাধা দিতে হলে সেটাও আমরা দেবো।’

সাম্প্রতিক শীতল অবস্থা নিয়ে একই বক্তব্য ডা. মাহফুজুর রহমানেরও। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আন্দোলন তো ঠিকঠাক মতই চলছে। সিনিয়র অনেকে বিভিন্ন কারণে যাচ্ছেন না। যেমন ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল করোনা আক্রান্ত। তো এসব কারণে এখন আমি প্রতিদিন যাচ্ছি।’

আন্দোলনে রাজপথের বাইরেও অনেকগুলো বিষয় আছে মন্তব্য করে সেগুলো নিয়েও কাজ এগোচ্ছে— এমন কথা জানিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এখানে এখন যেগুলো হচ্ছে সেগুলো একটা সংকট তৈরি করার জন্যই করা হচ্ছে। রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে, গেইট বসাচ্ছে। তারা চাচ্ছেই সেখান একটা বিশেষ পরিস্থিতি হোক। আমরা এই ফাঁদে পা দিতে চাচ্ছি না। তবে আমরা আমাদের কাজ করছি।’

কী ধরনের কাজ— এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মাহফুজ বলেন, ‘তাদের চারটা বড় জালিয়াতি আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো নিয়ে খুব শীঘ্রই আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবো। এই আন্দোলনের সাথে আইনি লড়াইয়েরও প্রয়োজন হবে। সেগুলোর প্রস্তুতিও চলছে।’

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবিতে নির্মাণাধীন ‘স্টাবলিশমেন্ট অব এ ৫০০ বেড মাল্টি স্পেশিয়ালিটি হসপিটাল অ্যান্ড এ ১০০ সিট মেডিকেল কলেজ অন বাংলাদেশ রেলওয়ে সিট অ্যাট চিটাগাং’ শিরোনামে প্রকল্পটি রেলওয়ের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি প্রকল্প। ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এরপর ওই বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯৮ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। নির্মাণকালের প্রথম পর্যায়ের তিন বছরে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কমপক্ষে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করবে সিআরবিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পরবর্তী ২৪ মাসের মধ্যে আরও ২৫০ শয্যার হাসপাতাল কার্যক্রম চালু করবে। প্রকল্পের ছয় একর জমির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২ দশমিক ৪২ একর ও দ্বিতীয় ধাপে ৩ দশমিক ৫৮ একর জমি ব্যবহার করবে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ। ৫০ বছর পর এই প্রকল্পের পুরো মালিকানা পাবে রেলওয়ে।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য কোনো গাছ কাটা হবে না এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি করা হবে না বলে ঘোষণা দিলেও পরিবেশবাদীরা বলছেন, সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সেটা পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করবে।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!