সাড়ে ৩৭ কোটি টাকার অবিশ্বাস্য লুটপাট কক্সবাজার মেডিকেলে, প্রমাণ পেয়েও নিশ্চুপ ঢাকার দুদক
চাহিদাই ছিল না, তবু কেনা হয় নিম্নমানের যন্ত্রপাতি
আসবাবপত্র কিংবা যন্ত্রপাতি— কোনোটিরই ছিল না চাহিদা। এমনকি বিভাগীয় প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়েও কোনো চাহিদা পাওয়া যায়নি। শেষমেশ দুর্নীতিবাজদের চক্রটি নিজেরাই তৈরি করলেন চাহিদা। সে অনুযায়ী আসবাবপত্র ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য নিজেরাই আহ্বান করলেন দরপত্র। সেই দরপত্রে কাজও পেল নিজেদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই। পরে ব্যবহারের অনুপযোগী আসবাবপত্র ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতিতে বিভিন্ন দেশের ভুয়া লেবেল লাগিয়ে সেগুলো সরবরাহও করা হল। এরপর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তুলে নেওয়া হল ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ টাকার বিল। অথচ পুরো প্রক্রিয়ার একটিতেও তারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি।
এমনই অবিশ্বাস্য দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে। ঠিকাদারির এই কাজ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আলোচিত সেই কর্মচারী আবজাল ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে বিপুল টাকার এই দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজেরই সাবেক দুই অধ্যক্ষ ডা. রেজাউল করিম এবং ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা। এছাড়াও জড়িত ছিলেন আরও অনেকেই।
দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত করে দুর্নীতির এই ঘটনার সন্দেহাতীত প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ চেয়ে প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন দাখিলের প্রায় দেড় বছর বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত এই ফাইল চাপা পড়ে আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে।
দুদকের তদন্তে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তরা হলেন— চট্টগ্রামের জামালখান রোডের সানমার ম্যাগনোলিয়া ভবনের বাসিন্দা (বর্তমান ঠিকানা) ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম (৬১) এবং অধ্যাপক ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা (৫৮), ঢাকার মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন এবং লাইন ডাইরেক্টর প্রি-সার্ভিস এডুকেশনের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রশিদ (৫৭), ঢাকার মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেন (৪৬), আবজাল হোসেনের স্ত্রী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক স্টেনোগ্রাফার ও রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী রুবিনা খানম (৪০), কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া (৫৩), কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কার্যালয়ের এসএএস সুপার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সুরজিত রায় দাশ (৬০), কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কার্যালয়ের অডিটর পংকজ কুমার বৈদ্য (৫৪), কক্সবাজার চকরিয়া থানার ডুলাহাজার পশ্চিম মাইজপাড়ার এটিএম মাইনুল এ হাসান চৌধুরীর স্ত্রী ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের হিসাবরক্ষক হুররমা আক্তার খুকী (৩৮) এবং ঢাকার মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক উচ্চমান সহকারী বর্তমানে প্রধান সহকারী মো. খায়রুল আলম (৪৫)।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর কক্সবাজার মেডিকেলের যন্ত্রপাতি সরবরাহের অনিয়মের বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু হয়। পরে ২ ডিসেম্বর এটি তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর দফতর। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ অনিয়মের অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের শুরুর দিকে কমিশন বরাবরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ চেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি প্রয়োজন না থাকার পরও ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয় সংক্রান্ত কাজ সম্পাদনের জন্য এমএসআর নির্বাচন ও স্পেসিফিকেশন, বাজার দর যাচাই, দরপত্র উন্মুক্তকরণ, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, সার্ভে কমিটি (এমএসআর) গঠন পূবর্ক (নাম ব্যতিত) অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে ঢাকা মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রশিদ বরাবরে।
২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ওই দফতর থেকে দরপত্র উন্মুক্তকরণ, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, সার্ভে কমিটি ও কোটেশন সংক্রান্ত কমিটি গঠনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন দেওয়ার আগেই ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই নিজেদের উদ্যোগে দরপত্র কমিটি গঠন করে ফেলে কক্সবাজার মেডিকেল কর্তৃপক্ষ।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিজ নিজ বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় কম্পিউটার, এক্সেসরিজ, এমএসআর, ইন্সট্রুমেন্ট ও ইকুইপমেন্ট, বুকস এন্ড জার্নাল, ফার্নিচার ও স্পোর্টস আইটেম এবং কেমিক্যাল ও রি-এজেন্টের চাহিদাপত্র জমা দেওয়ার জন্য কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সকল বিভাগীয় প্রধান বরাবরে চিঠি পাঠানো হলেও এরপর ওই মেডিকেলে কর্মরত বিভাগীয় প্রধানদের কেউই যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কোনো ধরনের চাহিদাপত্র পাঠাননি।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সকল বিভাগীয় প্রধান ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ৭টি প্যাকেজে বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি কেনার জন্য হঠাৎ দরপত্র বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করা হয়। কথিত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ‘সর্বনিম্ন দরদাতা’ হিসেবে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সুপারিশও পাঠিয়ে দেয়।
২০১৬ সালের ১ অক্টোবর দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক শাখায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনের জন্য তারা আর অপেক্ষা করে থাকেনি। কক্সবাজার মেডিকেলের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. রেজাউল করিম নিজেই ১১টি কার্যাদেশের মাধ্যমে কথিত ‘সর্বনিম্ন দরদাতা’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৮০ টাকার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেন। অথচ এতে পিপিআর-২০০৮ ও পিপিএ-২০০৬ এ বিধিমালা অনুসরণও করা হয়নি।
দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দরপত্রের কার্যাদেশ অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে ব্যবহারের অনুপোযোগী নিম্নমানের যন্ত্রপাতি বিভিন্ন দেশের ভুয়া লেবেল লাগিয়ে সরবরাহ করে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রশাসনিক শাখার সাবেক উচ্চমান সহকারী খায়রুল আলমের সহায়তায় ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬টি স্মারকের মাধ্যমে ঠিকাদারের অর্থের প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে।
এরপর ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে যন্ত্রপাতির সরবরাহের বিল পরিশোধ করা হয়। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা ও হিসাবরক্ষক হুররমা আক্তার খুকী এসব বিল তৈরি করেন।
জানা গেছে, কথিত এই ‘সর্বনিম্ন দরদাতা’ রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল মূলত ঢাকার মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক স্টেনোগ্রাফার রুবিনা খানমের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালেই মাত্র ৩০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনার নামের থাকা ২৫টি বাড়ি-প্লট ও জমি জব্দ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জব্দ করা ২৫টি বাড়ি-প্লটের মধ্যে ১৫টি ঢাকায়। এছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, এবি ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের নামে থাকা কয়েকটি অ্যাকাউন্ট এবং রুবিনার নামে থাকা ২০০০ সিসির ‘টয়োটা হ্যারিয়ার’ একটি গাড়িও জব্দ করা হয়েছে। ঢাকার উত্তরায় আবজাল ও তার স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পের (ফরিদপুর, কুমিল্লা, খুলনা, দিনাজপুর ও বগুড়া) কার্যালয়ের অধীনে স্টেনোগ্রাফার পদে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে তিনি অবসরে যান। তিনি ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স নেন। পরে স্বামী-স্ত্রী মিলে অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটাসহ অন্যান্য কাজে একচেটিয়া ব্যবসা করেন। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়, অভিযুক্তরা অসৎ উদ্দেশ্যে ও পরস্পর যোগসাজশে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি চাহিদা না থাকার পরও ব্যবহার অনুপযোগী ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে মোট ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। পরে আত্মসাৎকৃত এসব অর্থ হস্তাস্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরও করেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭৭ক ও ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা সহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সাবেক উপপরিচালক (ডিডি) রতন কুমার দাশ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কক্সবাজার মেডিকেলের অনিয়মের বিষয়টি শুরুতে ঢাকা থেকে তদন্ত করা হয়। পরে আমাদেরকে এটির তদন্ত করতে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এখান থেকে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে কমিশন বরাবরে দাখিল করা হয়েছে।’
কখন প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে। বর্তমানে এটি ঢাকা থেকে দেখছে।’
সিপি