সাপ থেকে বিষের দাওয়াই তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামে, মেডিকেলে ‘ভেনম সেন্টার’
বছরে সাপের কামড়ে আহত হন ১ লাখ মানুষ
বাংলাদেশের সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় বর্তমানে ভারত থেকে আনা প্রতিষেধক ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দেশে এই প্রতিষেধক তৈরি করতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প
বাংলাদেশের সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় ভারত থেকে আনা প্রতিষেধক ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে এই প্রতিষেধক তৈরি করতে ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এক প্রকল্পের আওতায় গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের কাজে সহায়তা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির গ্যোটে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা।
প্রথমে কোয়ারেন্টিন
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাপ ধরার পর গবেষকেরা প্রথমে সেগুলোকে কোয়ারেন্টিনে রাখেন। এরপর একজন পশু চিকিৎসক সাপগুলোর শারীরিক সমস্যা শনাক্ত করে চিকিৎসা দেন। তারপর সাপ সংগ্রহের মূল কক্ষে নেওয়া হয় সেগুলোকে।
আন্তর্জাতিক নির্দেশনা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে সাপ রাখার বিশেষায়িত কক্ষের বাতাস নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মাথায় হেলমেট, গায়ে বিশেষ অ্যাপ্রোন ও পায়ে বুট পরে ওই কক্ষে ঢুকতে হয়। এরপর বের হয়ে হাত ও পরিধেয় কাপড় স্যানিটাইজ করতে হয়।
যেন ফাইভ স্টার হোটেল
কিছু সাপ নিশাচর, আবার কিছু দিবাচর। যেগুলো রাতে শিকার করে— সাপ রাখার কক্ষে সেগুলোকে আলাদা করে পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন দিনের বেলা তারা ভালভাবে ঘুমাতে পারে। প্রকল্পের কো-ইনভেস্টিগেটর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী জানান, সাপগুলোকে অত্যন্ত যত্নের সাথে রাখা হয়। এই অবস্থাকে তিনি ‘পাঁচ তারকা হোটেলে’ অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রয়োজন সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি
প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষের মতে, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় জনসচেতনতা, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং জাতীয় চিকিৎসা গাইডলাইন— এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে ভারত থেকে যে অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) আনা হয় সেটি পলিভ্যালেন্ট, যা ভারতের চারটি বিষধর সাপের বিষ থেকে তৈরি। স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করা শতভাগ কার্যকর অ্যান্টিভেনম তৈরি এবং প্রান্তিক পর্যায়ে তা পৌঁছানোই এ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য।
ডিম ফোটানো হয় গবেষণাগারে
বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপের কিছু বাচ্চা সংগ্রহ করার পাশাপাশি গবেষকরা গবেষণাগারেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এ প্রকল্পের গবেষণা সহকারী দিলরুবা আক্তার ল্যাবে জন্ম নেওয়া সাপের বাচ্চাগুলোকে দেখভাল করছেন।
প্রজনন ঘর
সাপগুলোর স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজননের জন্য ২-৩ মাস সেগুলোকে টেরারিয়াম বা প্রজনন ঘরে রাখা হয়। এ ঘরে প্রাকৃতিক পরিবেশের আদলে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এখানে প্রতিটি উপকরণ জীবাণুনাশক দিয়ে একাধিকবার জীবাণুমুক্ত করা হয়ে থাকে।
সাবধান
মানুষ দেখামাত্রই সবুজ বোড়া বা গ্রিন পিট ভাইপারের বাচ্চাটিকে ‘প্রি-স্ট্রাইকিং পশ্চার’ নিতে দেখা গেল। এর অর্থ হচ্ছে, এটি সামনে থাকা বস্তুটিকে তার জন্য বিপজ্জনক মনে করছে এবং আঘাত করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। সহকারী গবেষক মোহাম্মেদ নোমান জানান, এটি তার শত্রুর জন্য একপ্রকার সাবধানবাণী।
গরমপ্রধান অঞ্চলে সাপের আধিক্য
বাংলাদেশে সামুদ্রিকসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতির সাপ মানুষের জন্য বিপজ্জনক। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এতো পরিমাণ সাপের উপস্থিতি পৃথিবীতে বিরল। সরকারি হিসাব মতে, বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আহত হন এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ মারা যান। ক্রমশ এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
চলছে বিষ সংগ্রহ
খৈয়া গোখরা বা বাইনোসেলেট কোবরা থেকে বিষ সংগ্রহ করছেন একজন গবেষণা সহকারী। মূলত গ্লাস ক্যাপিলারি এবং গ্লাস বিকার পদ্ধতিতে সাপগুলো থেকে বিষ সংগ্রহ করা হয়। বিষ সংগ্রহের এ কাজে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড়শটি সাপ সংরক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জানান, কমপক্ষে ৫০০ সাপ সংগ্রহ না হলে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন শুরু করা যাবে না।
পালা হচ্ছে মুরগি ও ইঁদুরের বাচ্চা
আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে এ প্রকল্পের আওতায় সাপগুলোকে খাওয়ানোর জন্য গবেষণাগারে পালা হচ্ছে ছোট মুরগি ও ইঁদুরের বাচ্চা। কিছু সাপের আবার প্রিয় খাদ্য অন্য প্রজাতির সাপ। সেগুলোর জন্য বনজঙ্গল থেকে সাপ ধরে এনে আলাদা করে রাখা হয়।
সাপে কাটা রোগী
চট্টগ্রামের রাউজান থেকে আসা সন্ধ্যা মুহুরী লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে সাপের কামড়ে আহত হন। তার কাছ থেকে বর্ণনা শুনে সাপটি গ্রিন পিট ভাইপার প্রজাতির বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা। স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম না থাকায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডয়চে ভেলে অবলম্বনে