সাতকানিয়ার ত্রাস টাইগার ফারুক আবার ধরা, বন্দিশালা থেকে উদ্ধার তিন সন্তানসহ গৃহবধূ
ছাড়াতে তৎপর মিন্টু বাহিনীর সাঙ্গপাঙ্গরা
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সন্ত্রাসী ফারুক ওরফে টাইগার ফারুককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সন্ত্রাসী ফারুক নলুয়ার স্থানীয় মিন্টু বাহিনীর অস্ত্রধারী ক্যাডার। পুলিশের অভিযানে একইসঙ্গে ফারুকের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জোরপূর্বক আটকে রাখা এক গৃহবধূ ও তার তিন সন্তানকে।
রোববার (৯ অক্টোবর) দুপুরে ফারুককে পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গৃহবধূকে জোর করে আটকে রাখার ঘটনায় তার স্বামী গত ৬ অক্টোবর আদালতে নালিশী মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে লিপিবদ্ধ করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন সাতকানিয়া থানার ওসিকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোববার ফারুককে গ্রেফতার করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। ১০ অক্টোবর তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, নারী নির্যাতন মামলায় গ্রেফতারের পর থেকে মিন্টু বাহিনীর অনুসারীরা তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। তবে পুলিশ বলছে, ফারুকের মতো ভয়ানক সন্ত্রাসীকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অস্ত্র আইনসহ বেশ কিছু মামলা আছে। তার অত্যাচারে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ট দীর্ঘদিন ধরে।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক মো. আবদুল হান্নান বলেন, এলাকার একটি প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে টাইগার ফারুক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যখন তখন যে কারো সাথে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পটু ফারুক। অল্প টাকায় যেকোনো কাজ করানো যায় তাকে দিয়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ওই প্রভাবশালীরা। এভাবে পুরো এলাকার সাধারণ মানুষকে তারা জিম্মি করে রেখেছে। প্রায় প্রতিদিনই ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতো আমাদের কাছে। সর্বশেষ নারী নির্যাতন মামলায় সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে হাজতে পাঠানো হয়েছে। স্বামী জহিরের মামলায় ফারুকের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসী ফারুক নলুয়ায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। এলাকায় চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদকসেবন ও বিক্রি, ভূমি দখল, মারামারি, বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে ভাড়ায় খাটাসহ সব ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত স্থানীয় মিন্টু বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ফারুক।
জানা গেছে, নলুয়ার পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের হাঙ্গরমুখ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করছে মিন্টু বাহিনী। বর্তমানে মিন্টু প্রবাসে থাকলেও এলাকায় তার হয়ে বাহিনী পরিচালনা করেন কামাল উদ্দিন। সশস্ত্র এ বাহিনী এলাকায় শুধু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে তাই নয়, সামাজিক ও পারিবারিক শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট করে পুরো এলাকাকে নানাভাবে অস্থিতিশীল করে রেখেছে বছরের পর বছর।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ করেন বাহিনীর সদস্য মনজুর ওরফে কানা মনজু। ফারুকসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের মাদকসেবন করিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বিভিন্ন অভিযানে পাঠান মনজুর। বাহিনী প্রধান মিন্টুর ভাগ্নে স্থানীয় মেম্বার মোরশেদ আলম ওই বাহিনীর বড় শক্তি। মোরশেদ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সাফাই গেয়ে সন্ত্রাসীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসীদের জন্য তদবির করেন। মোরশেদ ইউপি মেম্বার হওয়ার পর থেকে মিন্টু বাহিনী এলাকায় আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ফারুক নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়া ডেঙ্গা গ্রামের শামসুল ইসলামের ছেলে। এলাকার ছিঁচকে চোর থেকে এখন হয়ে ওঠেছে বড় সন্ত্রাসী। মিন্টু প্রবাস থেকে নিয়মিত টাকা দিয়ে থাকেন ফারুকসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের। ফারুক মিন্টুর নির্দেশে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে এলাকায়।
সূত্রমতে, ফারুকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা রয়েছে সাতকানিয়া থানায়। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট রাতে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মহিউদ্দিনের বাসায় গুলি করে হত্যা চেষ্টা মামলায় ফারুক কারাগারে যান। সেখান থেকে মিন্টুর সহযোগীদের নানা তদবির ও চেষ্টায় ফারুককে জামিনে বের করে আনা হয়। কিন্তু জামিনে এসেই নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করেন ফারুক। এ ঘটনায় তখন ভিকটিমের নানা থানায় এজাহার দাখিল করেন। পরবর্তীতে ফারুক ফোনে বিভিন্ন হুমকি ধমকি দিলে তা আর বেশি দূর এগোয়নি। মামলা করলে ভিকটিমের মামাকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয় তখন।
জানা গেছে, ফারুক চলতি বছরের শুরুর দিকে পার্শ্ববর্তী আমিলাইশ ইউনিয়নের এক ব্যক্তির স্ত্রীকে অস্ত্রের মুখে তুলে এনে বসবাস শুরু করে। অথচ তাদের মধ্যে দেশের প্রচলিত আইন ও ইসলামি শরিয়া মেনে বিয়ে হয়নি। অস্ত্র আইনের মামলায় ফারুক জেলে গেলে তখন ওই মহিলা পালিয়ে চলে যান স্বামীর কাছে। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে ফারুক ওই মহিলার নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণ করে এবং মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মেয়েকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ওই মহিলাকে আবারও জিম্মি করে ফারুক।
ফারুক আগেও একইরকম অপরাধ সংঘটিত করেছে। হিলমিলি এলাকার মনু আকতার নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেন তিনি। সেই ঘরে একটি পুত্রসন্তান আছে। তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়নি। পরবর্তীতে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের এক মহিলাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যান সন্ত্রাসী ফারুক। কিছুদিন পর তাকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘরেও এক সন্তান রয়েছে। ফারুকের হুমকি ধমকিতে এই দুই পরিবারই এখন চরম অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতায়। মূলত মিন্টু ও কামাল, কানা মন্জু, মোরশেদ মেম্বারই ফারুককে আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তাই আইনের আশ্রয় নিতে সাহস পাচ্ছে না কেউ।
জানা গেছে, পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের মো. বকসুর ছেলে ফখরুদ্দিন মিন্টু ও কামাল উদ্দিন দুজনই প্রবাসী। প্রবাস থেকে কিছুদিন পর পর তারা দেশে এসে বিভিন্নভাবে গায়ের জোরে কতৃত্ব খাটান। একজনের সাথে আরেকজনকে লাগিয়ে দিয়ে নিজেরা ফায়দা লুটেন। খোদ তাদের আপন বড় ভাই মোস্তাক এখন তাদের অত্যাচারে এলাকাছাড়া। জমি থেকে ধান পর্যন্ত ঘরে তুলতে দেওয়া হয় না মোস্তাককে। একইভাবে পুরো এলাকার মানুষ এখন মিন্টু বাহিনীর হাতে জিম্মি।
সম্প্রতি নলুয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়েও এই চক্রটি এলাকায় ঝামেলা তৈরি করেছে। সম্মেলনের মাধ্যমে থানা ও ইউনিয়নের নেতারা কমিটি ঘোষণা দিলেও মিন্টু-কামাল চক্র সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে না। তাই তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে ঘোষিত কমিটির নেতাদের নানাভাবে হয়রানি ও অপদস্থ করা হচ্ছে এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের কমিটিতে আনার জন্য নানা টালবাহানা শুরু করেছে বলে অভিযোগ মিলেছে। জানা গেছে, এর অংশ হিসেবে থানা ও ইউনিয়ন নেতাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে পাল্টা ওয়ার্ড কমিটি। অথচ এই বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। তাদের প্রভাবের কাছে থানা ও ইউনিয়নের নেতারাও যেন অসহায়।
সিপি