সাতকানিয়ার করোনাকাণ্ডে তিন কানেকশন— নারায়ণগঞ্জ-টেরিবাজার-রেয়াজউদ্দিন বাজার

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় এখন পর্যন্ত তিনজন করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর বাইরে সাতকানিয়ার আরও একজন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জে ব্যবসা করা ওই ব্যক্তি করোনায় শনাক্ত হওয়ার দুইদিন আগেও ছিলেন সাতকানিয়ায়। এই চারজনের কন্টাক্ট ট্রেসিং বা যোগাযোগ-সূত্রে চলে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর, নারায়ণগঞ্জ ও টেরিবাজার-রেয়াজউদ্দিন বাজার কানেকশনের কথা। পাশাপাশি গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ সাতকানিয়ায় ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

সাতকানিয়াকে ঘিরে একটা ‘ক্লাস্টার’ (গুচ্ছ) গড়ে উঠছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে স্বীকার করে প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা বলছেন আরও দুই একদিন সময় নিতে চান তারা।

সাতকানিয়ায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জ ব্যবসা করা ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার আগে এক রাত ছিলেন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামে।

এরপর সাতকানিয়ার দ্বিতীয় রোগী হিসেবে যিনি শনাক্ত হন তিনি চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার একজন ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম নগরীর ৩ নম্বর ফকিরহাটে একটা স্টেশনারি ও পান-সিগারেটের দোকান করতেন তিনি। গত ২২ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশায় নিজের বাড়িতে ফেরেন তিনি। এর কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আনার পথে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায় করোনা পজেটিভ ছিলেন তিনি। তবে ততোক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার জানাজায় হয়ে যায় ব্যাপক লোকসমাগম। যা ঝুঁকিতে ফেলেছে ৪০০ পরিবারের অন্তত ৪ হাজার মানুষকে। করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া ওই ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে আসায় তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছে সাতাকানিয়ার উপজেলা প্রশাসন।

সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র মতে, পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডে ৩৪৩টি পরিবার, মাদার্শা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মক্কারো বাড়ি এলাকায় ১০টি পরিবার, ২ নং ওয়ার্ডের রূপনগরে ১২টি পরিবার, সাতকানিয়া পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের সামিয়ার পাড়ায় ২টি পরিবার, ৫ নং ওয়ার্ডের ছিটুয়া পাড়ায় ১৫টি পরিবার, ৭ নং ওয়ার্ডের ভোয়ালিয়া পাড়ায় ৩৩টি পরিবারসহ মোট ৪০০ পরিবারকে লকডাউন করা হয়েছে।

পরের দিন সাতকানিয়ার আরও দুজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়— যাদের একজন ১৯ বছর বয়সী কিশোর। সে ৩ দিন আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার পর তার বেশ কজন বন্ধুও তার সংস্পর্শে আসে। ৩২ বছর বয়সী অন্যজন পেশায় ঠিকাদার। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি সংক্রমিত হয়েছেন টেরিবাজার থেকে সাতকানিয়ার বাড়িতে ফেরা তার বন্ধুদের দ্বারাই। এমনটাই দাবি তার ব্যবসায়িক পার্টনারের। করোনা পজেটিভ ওই ব্যক্তির ব্যবসায়িক পার্টনার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সে (করোনা পজেটিভ রোগী) কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ। তার এলাকার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে টেরিবাজার ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা করে— এমন অনেকে এলাকায় ফিরলে তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেছে সে। আমার ধারণা তাদের দ্বারাই সংক্রমিত হতে পারে সে।’

নারায়ণগঞ্জ কানেকশনের পাশাপাশি টেরিবাজার আর রেয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক যোগাযোগ এখানে ঝুঁকির একটা বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সাতকানিয়ার প্রচুর লোকজন টেরিবাজার ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা করেন। এদের সাথে নারায়ণগঞ্জের একটা যোগাযোগ আছে ব্যবসায়িক কারণে। চলমান পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে ফিরেছেন বাড়িতে। তাদের অনেকে আবার কোয়ারেন্টাইন মানেনি।’

সাতকানিয়ায় করোনার সামাজিক সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না এখানকার জনপ্রতিনিধিরাও। সাতকানিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. এনাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেকে নারায়ণগঞ্জ থেকে এলাকায় আসছে। টেরিবাজার আর রেয়াজউদ্দিন বাজার নিয়েও আলোচনা আছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উনাদের অনেকেরই নারায়ণগঞ্জের সাথে যোগাযোগ আছে। কাজেই এখানে একটা বড় ঝুঁকি আছে।’

এর মধ্যে আরও আতঙ্কিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে গত ৩ মার্চ। এদিন ভোরে মারা যান চট্টগ্রাম টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গণি চৌধুরী। ওইদিন বিকেলে সাতকানিয়া মডেল হাই স্কুল মাঠে তার জানাজায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। এটি সংক্রমণ ছড়ানোতে মারাত্মক ভয়াবহ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

জনপ্রতিনিধি হয়েও করোনার তীব্র ঝুঁকির সময়ে এই জানাজা আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘সাতকানিয়া একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ থেকে অনেকেই এসেছেন। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে। উপজেলা প্রশাসনও কাজ করছে। প্রথম দিকে মানুষ একেবারেই কেয়ার করেনি। পশ্চিম ঢেমশায় উনি মারা যাওয়ার পর এখন মোটামুটি সবাই ভয়ে আছে।’

সাতকানিয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-আলম বলেন, ‘আক্রান্ত ৪ জনের দুজনের সাথে সরাসরি নারায়ণগঞ্জের সম্পৃক্ততা আছে। আর টেরিবাজার ও রেয়াজউদ্দিন বাজার নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আমরা সবগুলো বিষয়কেই আমলে নিচ্ছি। এর মধ্যে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। আমরা ৪ হাজারেরও বেশি বাড়ি লকডাউন করেছি।’

পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কিনা— এই প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ‘আমরা আরও বেশ কিছু নমুনা পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছি। নমুনাগুলোর ফল পেলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!