সাতকানিয়ায় রাতে এবার বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা, তিন দিনে তিন খুনের একটি ‘অস্বাভাবিক’

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় এখন প্রতিদিনই ঘটছে খুনের ঘটনা। এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কার্যত ভেঙে পড়েছে। গত তিন দিনে দুটি খুন ছাড়াও আরও একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত এই উপজেলায়। এ নিয়ে গত দেড় মাসে পাঁচজন খুন হলেন।

সর্বশেষ সোমবার (১৫ জুলাই) দিবাগত গভীর রাতে পুরানগড় ইউনিয়নে এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে শনিবার (১৩ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কালিয়াইশ ইউনিয়নের বিওসি মোড়ের কলোনিতে ইব্রাহিম নামের এক যুবককে ছুরির আঘাতে নির্মমভাবে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় আরও একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওই একইদিন দিবাগত রাত ১টার দিকে পুরানগড় ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তর বৈতরণী দাউন্দা এলাকায় সালিশি বৈঠকে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের বেদম মার খেয়ে কামাল উদ্দিন (২৮) নামের এক যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

খুনের সর্বশেষ ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (১৫ জুলাই) দিবাগত রাতে সাতকানিয়ার পুরানগড় ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের জানু সিকদার বাড়ি এলাকায় মোহাম্মদ মোক্তার নামে ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় কাজী জেয়াবুল হোসেন নামের আরও একজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

জমিজমার বিরোধে স্থানীয় প্রতিপক্ষ খুনের এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। নিহত মোক্তার ওই এলাকার মৃত আহমদ হোসেনের পুত্র।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোক্তারের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছিল প্রতিবেশী ভুট্টো ও ফরিদের সঙ্গে। এর জের ধরেই প্রতিপক্ষ দা দিয়ে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বেধড়ক কুপিয়ে জখম করে মোক্তারকে।

এ ঘটনায় গুরুতর আহত মোক্তারকে তার স্বজনসহ স্থানীয়রা দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মোক্তার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় গ্রামপুলিশ রফিক ও হারুন।

পুরানগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম সিকদার বলেন, মোক্তার খুবই সহজ সরল ও সোজাসাপটা মানুষ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। মোক্তার তার চলাচলের রাস্তা পরিস্কার করার সময় ফরিদ ও ভুট্টো তাদের বাবা-মা-বউসহ আজকে অতর্কিতভাবে তার ওপর হামলা করছে বলে শুনেছি। বিষয়টা আমার চৌকিদার হারুন আমাকে নিশ্চিত করেছেন।’

চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম সিকদার আরও বলেন, ‘আজকের ওই ঘটনায় আমার ইউনিয়নের কাজী জেয়াবুল হোসেনও আহত বলে শুনেছি। তবে হামলাকারী কিংবা নিহতের স্বজন ও আহতদের পরিবার থেকে কেউ আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমি তাদের এই সীমানাবিরোধটি গত বছরও একবার সমাধান করে দিয়েছিলাম। মূলত ফরিদ-ভুট্টোরা পেশাদার খারাপ প্রকৃতির হওয়ায় সমাধান পর্যন্ত এগোয়নি।’

প্রায় প্রতিদিনই খুন সাতকানিয়ায়

এর আগে শনিবার (১৩ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কালিয়াইশ ইউনিয়নের বিওসি মোড়ের কলোনিতে ছুরির আঘাতে ইব্রাহিম নামের এক যুবক নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও একজন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

ওই একইদিন দিবাগত রাত ১টার দিকে পুরানগড় ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তর বৈতরণী দাউন্দা এলাকায় স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক কলহের ঘটনায় সালিশি বৈঠকে স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুনুর রশীদের হাতে প্রচণ্ড মার খাওয়ার অপমান সইতে না পেরে কামাল উদ্দিন (২৮) নামের এক যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। পরে এ ঘটনায় অভিযুক্ত ইউপি সদস্যের বদলে সাতকানিয়া থানার পুলিশ আত্মহত্যাকারী যুবকের স্ত্রীকেই উল্টো গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ৯ জুন বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তাঁতীপাড়া এলাকার ফজল করিম মেম্বারের গরুর ফার্মের পূর্ব পাশে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ফজল আহমদ (৫৫) নামের এক কৃষককে। তিনি সোনাকানিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুব পাড়ার সাচি মিয়ার পুত্র। ঘটনার পর হত্যাকারী সন্দেহে আবুল কাশেম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও পরবর্তী কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। নিহত ফজল আহমদের স্ত্রী রেহেনা আক্তার বলেন, ‘বাড়ির উত্তর পাশের কুতুব পাড়ার আবুল কাশেম ও তার ছেলে তৌহিদ আমার স্বামীকে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমার স্বামী খুবই নিরীহ লোক ছিল। আমার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে।’

গত ২৯ মে রাত ৮টার দিকে সাতকানিয়ার আমিলাইশ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ আমিলাইশে কয়েক দফা পিটিয়ে সদ্যবিবাহিত এক পিকআপচালককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মো. মহিউদ্দিন (২৫) নামের ওই পিকআপচালককে গাড়িসহ আটক করে কয়েক দফা পেটানোর পর তিনি মারা যান।

গত ২৮ মে উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড সর্দারপাড়ায় ছুরিকাঘাতে মাহমুদুল হক (৩৩) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে পেটে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। নিহত মাহমুদুল গত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন। গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই তিনি হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন বলে স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। সম্প্রতি ওই ইউনিয়নে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়ার পর এই হুমকি আরও বেড়ে যায়। সর্বশেষ খুনের ঘটনার আগের দিনও প্রাণনাশের হুমকি পান তিনি।

দিনেদুপুরে খুনের এ ঘটনায় সাতকানিয়া থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে ৩ জুন চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত মাহমুদুল হকের বড় ভাই এনামুল হক (৪১)। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) ফৌজদারি অভিযোগটি সরাসরি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। নৃশংস খুনের এই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ছদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান জয় (২৫) ছাড়াও স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের আট সদস্য। এর মধ্যে গত ৮ জুলাই মাহমুদুল হক হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত সাকিব প্রকাশ টোকাই সাকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm