সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খেলছেন সরওয়ার জাহান, দুর্নীতি ঢাকতে ভিসিকে হয়রানি
বিতর্কিত লোকে ভরা ট্রাস্টি বোর্ড সহায়তা দিচ্ছে অনিয়মে
২০২১ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ চার বছরের জন্য সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার ড. মো. মোজাম্মেল হককে নিয়োগ দেন। কিন্তু তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চলতি বছরের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার স্থলে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া কোষাধ্যক্ষ ড. শরীফ আশরাফউজ্জামানকে।
১০ সেপ্টেম্বর সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাম্মেল হককে যথাযথভাবে অব্যাহতি না দেওয়ায় তিনি স্বপদে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা-১।
কিন্তু সেই নির্দেশনা মানছে না বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড। মন্ত্রণালয়ের আদেশের পর যোগদান করতে যানবাহন পাঠানোর অনুরোধ করে একটি চিঠিও দেন মোজাম্মেল হক। তার সেই চিঠিও গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শুধু তাই নয়, কর্মস্থলে যোগদানের বাধা দিতে ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান আনসার ও ভাড়া করা মাস্তান দিয়ে পাহারা বসিয়েছে—এমন অভিযোগও করেছেন ড. মোজাম্মেল।
এনিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন ড. মো. মোজাম্মেল হক।
অভিযোগ রয়েছে, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একছত্র আধিপত্য বিস্তারে মূখ্য ভূমিকায় রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ডে কোনো সদস্য সচিবের কোনো পদ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে বিভিন্ন অনিয়মসহ অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির সঙ্গে জড়িত তিনি। বোর্ড অব ট্রাস্টির কয়েকজন বাদে বেশিভাগই চাপে পড়ে সরওয়ার জাহানের অবৈধ কর্মকাণ্ড সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। যারা সমর্থন দিচ্ছেন, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট ছিলেন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ও সদস্য মীর আবদুস ছালামের সঙ্গে আবার এস আলমের সখ্যতা বেশি। এস আলমসহ তাদের তিনজনেরই বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়।
জানা গেছে, সরোয়ার জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে জোর করে ড. মো. মোজাম্মেল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাঁয়তারা করছেন। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও ভিসির নামে নানা কুৎসা রটাচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা তা মেনে না নিলে সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দোহাই দিয়ে দু’দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না মেনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সাধারণ সভায় উপস্থিতির স্বাক্ষর নিয়ে সেই তালিকা ড. মো. মোজাম্মেল হককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের মূল ভূমিকা রয়েছেন ট্রাস্টিজ সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান। তিনি মূলত নিয়ম বহির্ভূতভাবে সার্টিফিকেট ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আমাকে যোগদান করতে বাধা দিয়ে আসছেন। নিয়ম না মেনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব পদ সৃষ্টি করে, সেটি নিজেই বাগিয়ে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ সার্টিফিকেট বিক্রির অনেক অভিযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করেছি, তাই আমাকে জোর করে সরিয়ে দিয়েছে। পরে আমার স্থলে সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগ থাকা ব্যক্তিকে বসিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে। যা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য লজ্জাজনক বটে।’
এদিকে ড. মোজাম্মেল জিডিতে উল্লেখ করেন, ওইদিন (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪ টা ২০ মিনিটে আমার দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত যানবাহন প্রেরণের জন্য চিঠি প্রদান করতে গেলে চিঠির বাহক মো. হামিদ উল্লাহকে (৩৬) ইউনিভার্সিটিতে দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি ইনচার্জ নাসির উদ্দিন অন্যান্য সিকিউরিটিসহ ঢুকতে বাধা দেন। জানানো হয়, উপর থেকে নিষেধ আছে। কোনো চিঠি গ্রহণ করা হবে না এবং ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। ইউনিভার্সিটিতে দায়িত্ব পালন করতে আমাকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের বাধা দেওয়ার লক্ষ্যে একদল লোক ও ১৫-২০ জন সশস্ত্র আনসার বাহিনী নিয়োগ করে প্রবেশপথে মোতায়েন করা হয়েছে।
সনদ নিয়ে বড় বাণিজ্য
ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে সনদ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ। অভিযোগ ওঠে, জালিয়াতির এমন সনদ মেলে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকায়। ২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব গ্রহণের পরই অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করে ৫০০টি স্নাতক সনদ যাচাই করে অধ্যাপক মোজাম্মেল হক দেখতে পান এর মধ্যে ১০৫টিই ভুয়া বা জাল।
সম্প্রতি বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অনিয়মের গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় তড়িঘড়ি করে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক। তিনি অভিযোগ করেন, ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহান এই জাল সনদ ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
ট্রাস্টি বোর্ডে বিতর্কিত ব্যক্তি
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। আর সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান। এছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন মীর আবদুস সালাম। যিনি চট্টগ্রামের এস আলমের গাড়িকাণ্ডের মূলহোতা। তিনি এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ছেলের শ্বশুর।
পাচার করা টাকায় বিদেশে অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকার সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে আলোচনায় আসা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
এছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের তালিকায় রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সাবেক সাংসদ আবদুচ ছালামও। যিনি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে আছেন।
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের তালিকায় রয়েছেন ইস্টার্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপি মামলার অন্যতম আসামি মোস্তফা গ্রুপের পরিচালক শফিক উদ্দিনও। যার পাসপোর্ট জব্দ করেছেন আদালত। তিনি জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর বেয়াই।
ঋণখেলাপের দায়ে অভিযুক্ত ফেরদৌস জাহান আলমগীরও রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
অন্য সদস্যরা হলেন—লিয়াকত আলী চৌধুরী, মো. ফেরদৌস ওয়াহিদ বাপ্পী, সরওয়ার জাহানের স্ত্রী ইশরাত জাহান, মামুন সালাম, নুরুল আবছার, প্রফেসর মো. এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী।
জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বিষয়টি দেখছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব সরওয়ার জাহানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সংযোগ তোলেননি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
ডিজে