মুমূর্ষু সাংবাদিককে ‘কারা’ ফেলে গেল সীতাকুণ্ডের ঝোপে— উদ্ধারকারীর বয়ান

‘ভাড়ায়’ খেটেছে প্রভাবশালী কোনো ‘শক্তি’?

‘ভাই, আমারে মাইরেন না। আমি আর নিউজ করব না’— পুলিশ এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের পা জড়িয়ে ধরে এভাবেই বিলাপ করছিলেন অপহরণের শিকার সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার। রোববার রাতে তাকে যখন সীতাকুণ্ডের কুমিরার খাল পাড়ের ঝোপ থেকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করতে যান, তখন অপহরণের শিকার ওই সাংবাদিকের গায়ে ছিল শুধু গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার। ধরন দেখে মনে করা হচ্ছে, অপহরণের পরিকল্পনাকারীদের ‘ভাড়াটে’ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে সংঘবদ্ধ কোনো ‘শক্তি’। অপহরণকারীরা চার দিন ধরে নির্যাতন চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক সরোয়ার নিজেই।

রোববার (১ নভেম্বর) রাত আটটার দিকে স্থানীয়রা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী একটি খালের পাশের ঝোপঝাড় থেকে গোলাম সরোয়ারকে উদ্ধার করে। এ সময় গোলাম সরোয়ারের গায়ে একটি গেঞ্জি ও আন্ডারওয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

স্থানীয় মর্জিনা ডেকোরেশনের মালিক বাবু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি প্রস্রাব করতে খাল পাড়ে গেছিলাম। এ সময় পাশের ঝোপঝাড় থেকে আওয়াজ শুনছিলাম— ভাই আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। তখন আমি একা থাকায় সেদিকে যাইনি। দ্রুত দোকানে এসে আমার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে সেখানে যাই।’

গত ২৯ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের আর খোঁজ মিলছিল না। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের পরিবার ও তার সহকর্মীরা। গোলাম সরোয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটিনিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক।

YouTube video

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন বাবু নামের ওই উদ্ধারকারী যুবক বলেন, ‘সেখানে গিয়ে দেখতে পাই তিনি (গোলাম সরোয়ার) পড়ে আছেন মাটিতে। তার গায়ে শুধু একটা গেঞ্জি আর একটা আন্ডারওয়্যার। উনাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন তিনি একজন সাংবাদিক। তখন আমরা উনার বসের নম্বর নিয়ে ফোন দিই। আমাদের মেম্বারকেও ফোন দিই। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।’

ঝোপঝাড়ে গোলাম সরোয়ার কিভাবে গেলেন এই বিষয়ে কিছু জানেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে বাবু বলেন, ‘আমি উনাকে ঝোপের মধ্যে দেখেছি। কিন্তু সেখানে তিনি কিভাবে এসেছেন এই বিষয়ে কিছু জানি না আমি। উনিও কিছু বলতে পারছিলেন না। খালি কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে বলছিলেন— প্লিজ ভাই আমি রিপোর্ট করবো না।’

রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে স্থানীয় মেম্বার আলাউদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গোলাম সরোয়ার ভাই এখনও আগের জায়গাতেই আছে। কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়নি। উনার সেন্স ছিল। তবে উনি কিছুটা দুর্বল ছিলেন। স্থানীয়রা তাকে খালের পাড় থেকে একটা ডেকোরেশনের দোকানে নিয়ে এসে একটু ম্যাসাজ-ট্যাসাজ করার পর তিনি পরিচয় দিছেন তিনি সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার। তবে তিনি কিভাবে সেখানে গেছেন এই বিষয়ে এখনও তিনি কিছু বলেননি।’

এর আগে সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কুমিরার একটা লেকের পাশে উনাকে পাওয়া গেছে অক্ষত অবস্থায়। স্থানীয় চেয়ারম্যান বিষয়টি থানাকে জানিয়েছেন। খবর পেয়ে থানা পুলিশ এখন ঘটনাস্থলে যায়।’

তবে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে অপহরণের পেছনে সাধারণ কোনো অপহরণকারী ছিল না বলেই স্থানীয়দের ধারণা। ধরন, নির্যাতনের মাত্রা— এসব বিবেচনায় রেখে তারা বলছেন, অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারীদের ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে সংঘবদ্ধ কোনো ‘চক্র’। সরকারের ভেতরে থেকে সুকৌশলে সরকারকেই বেকায়দায় ফেলারও এটি একটি ‘ষড়যন্ত্র’ হতে পারে— এমন ইঙ্গিতও আসছে অপহৃত সাংবাদিকের সহকর্মীদের অনেকের কাছ থেকে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে যা বললেন সাংবাদিক সরোয়ার

‘সাংবাদিকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরোয়ারকে তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়। ও সাংবাদিক, খবরদার ওকে হত্যা করা যাবে না’— অপহরণের পর মোবাইল কথোপকথনে এমন কথা বলতে শুনেছেন উদ্ধার হওয়া সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার।

উদ্ধার হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাশায়ী চট্টগ্রামের এই সাংবাদিক তার সহকর্মীদের জানিয়েছেন, ‘অপহরণকারীরা বারবার অজ্ঞাত লোকের সাথে কথা বলছিল। মোবাইলের অপর প্রান্তের লোককে স্যার স্যার করে কথা বলছিল।’

অপহরণের শিকার সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার জানান, তাকে তুলে নেওয়ার পর লোহার রড, লাঠি ও গাছ দিয়ে সারা শরীরে মারধর করা হয়েছে। অপহরণকারীরা মারতে মারতে তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন— ‘আর নিউজ করবি?

হাসপাতালে শয্যাশায়ী সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে চার জনে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আমার বাইকের পেছনে বসে এক লোক আমাকে কালো হেলমেট পরিয়ে দেয়। এটি পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছে— এমনটি বুঝতে পারি। আমাকে যেখানে রেখেছিল, সেখানে ট্রেন চলাচলের শব্দ শুনতাম।’

সরোয়ার বলেন, ‘আমি পাঠাও বাইকে করে বুধবার রাতের ১১টায় নগরীর কাজির দেউড়ি আলমাস সিনেমার পাশে বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলাম। ভিআইপি টাওয়ারের সামনে থেকে হঠাৎ জোর করে পাঠাও বাইকের পেছনে অপর একজন উঠে পড়ে। এরপর আর কিছুই মনে ছিল না আমার।’

‘নিউজের’ জন্যই অপহরণ

সাংবাদিক গোলাম সরওয়ারের সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, কোন্ সংবাদের কারণে গত চার দিন তার ওপর এমন নির্যাতন চলল? গোলাম সরোয়ারের করা দুটি প্রতিবেদন নিয়ে এর আগে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

শুরু থেকেই তার সহকর্মী সাংবাদিকদের দাবি ছিল, তাকে অপহরণ করা হয়ে থাকতে পারে। তারা বলছেন, গত কয়েক দিনে তিনি তার অনলাইন পোর্টালে দুটি ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এগুলোর জের ধরে তাকে অপহরণ করা হতে পারে তারা সন্দেহ করছেন। এর মধ্যে গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল— ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জায়গায় ভূমিমন্ত্রীর ভাইয়ের কুদৃষ্টি।’ ওই রিপোর্টে বলা হয়, ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জায়গা অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান। নগরীর সার্সন রোডের জেএস কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চলমান একটি ফ্ল্যাট প্রকল্পের জায়গা নিজের বাউন্ডারি ওয়াল যুক্ত করে দখলের চেষ্টা করছে। প্রকল্পের জায়গায় কাজ করতে গেলে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে এই ব্যবসায়ীকে।’ ঘটনাচক্রে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের বাসাও এই এলাকাতেই। তিনি সেখান থেকে বের হওয়ার পর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত তার অন্য একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল— ‘চট্টগ্রামে অভিজাতে ফের আলোচনা ক্যাসিনো’। এই রিপোর্টে শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতার ছেলের বিরুদ্ধে নগরীর খুলশীকেন্দ্রিক একটি ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলা হয়। ঘটনাচক্রে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরদিনই তিনি নিখোঁজ হন।

গোলাম সরওয়ারের সহকর্মী সাংবাদিকরা মনে করছেন, অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারীদের ‘ভাড়াটে’ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে সংঘবদ্ধ কোনো ‘শক্তি’। এই প্রভাবশালীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে পুলিশ প্রশাসন অসহায় ছিল বলেই গত চারদিন তাকে উদ্ধার করা যায়নি। অপহরণকারীদের তাদের ইচ্ছে অনুসারেই তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। আবার তাদের ইচ্ছা অনুযায়ীই ছেড়ে দিয়েছে গোলাম সরওয়ারকে।

এআরটি/এএস/এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm