সমন্বয়ক পরিচয়ে মহসিন কলেজে শিক্ষার্থী পেটাচ্ছে ছাত্রশিবির, পাহারা বসিয়ে মোবাইল চেক (ভিডিও)
ভয়ে পরীক্ষাও দিতে পারছে না অনেকে
চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের বিএসসি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সবুজ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় এই শিক্ষার্থী গত ১২ সেপ্টেম্বর অতর্কিত হামলার শিকার হন কলেজ ক্যাম্পাসেই। বহিরাগত কয়েকজন কলেজে ঢুকে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে তার মোবাইল ছিনতাই করে নেয়।
তাকে মারধরের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে মনিরুল ইসলাম নামে একজন লিখেন, ‘ছাত্রলীগের পাতি নেতা এখন সমন্বয়কের রূপ ধারণ করেছে। চট্টগ্রাম মহসিন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেছে।’ তবে মনিরুলের সেই পোস্টেই একাধিকজন নিশ্চিত করে লিখেন, ‘সবুজ ভাই এই ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিল।’ আন্দোলনের সময় সবুজ বহদ্দারহাটে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল থেকে একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারও দেন এমন একটি ফুটেজও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে আছে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সবুজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হঠাৎ বহিরাগত ১০-১২ জন ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে। আমার তিনজন বান্ধবীসহ কয়েকজন বন্ধুও ছিল সঙ্গে। রক্ষা করতে এলে মেয়েদের দিকেও তারা তেড়ে যায়। এর মধ্যে হান্নান নামের বাকলিয়া কলেজের একজনকে আমি চিনি। সে আগে থেকে শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। মনিরুল নামে যিনি মারধরের ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনিও দেখলাম শিবিরের রাজনীতি করেন। সম্ভবত কলেজের শিবিরের ছেলেরা তাদের দিয়ে এই হামলা করিয়েছে। কারণ আন্দোলনের পর আমরা ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত রাখার বিষয়ে কথা বলছিলাম।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেয় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে নারায়ে তকবির স্লোগান দিয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে কলেজে ঢোকে শিবিরের নেতাকর্মীরা। ওই সময় হোস্টেলগুলোও চলে যায় তাদের দখলে। তার আগেই গা ঢাকা দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও কলেজটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অভিযোগ এসেছে বারেবারেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নতুন পরিস্থিতিতে একই ভূমিকায় নেমেছে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ এ ধরনের হামলা ও নিপীড়ন এখন প্রতিদিনকার বিষয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটাচ্ছেন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকে অন্তত ১৭ শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। এর বাইরেও আরও অনেক শিক্ষার্থী শিকার হয়েছেন নিপীড়নের। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মোবাইল চেক করছে তারা। চেক করার নামে তাদের হাতে মোবাইল তুলে না দিলেও পেটানো হয় বলে জানা গেছে।
হামলার ভয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে পরীক্ষাও দিতে পারছে না। যাকে অপছন্দ হচ্ছে তাকেই ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রলীগের দোসর তকমা দিয়ে করা হচ্ছে মারধর। এই নিপীড়ন থেকে বাদ যাচ্ছে না ছাত্রী কিংবা শিক্ষকরাও। সবমিলিয়ে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে কলেজটিতে।
গত বুধবারও (১১ সেপ্টেম্বর) গাউছিয়া কমিটির মহসিন কলেজ শাখার সেক্রেটারি জোবায়েরকে নির্মম কায়দায় মারধর করা হয়। ইংরেজি বিভাগে ওই হামলা চলাকালে সহপাঠীকে রক্ষা করতে গিয়ে আঙ্গুল থেঁতলে যায় এক নারী শিক্ষার্থীর। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে সেই ছাত্রীর নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন তার বন্ধুরা।
কলেজটির কয়েকজন ছাত্রদলকর্মী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিবিরের নেতাকর্মীরা কিছুই মানতে চায় না। তারা আমাদের সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্মীদেরও মারধর করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও প্রতিদিন চড়াও হচ্ছে।’
মোবাইল চেক করতে বাধা দেওয়ায় ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) বর্তমান ইনচার্জ রাষ্ট্রবিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রিদোয়ানকে বেদম মারধর করে শিবিরকর্মীরা। গত ২৮ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে তাকে জিরো পয়েন্ট থেকে কলাভবনে গিয়ে মারধর করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। পরে বিএনসিসির প্লাটুন কমান্ডার আবুল বাসার গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেন।
সম্প্রতি মিরসরাই ও ফটিকছড়ির বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য মহসিন কলেজ বিএনসিসির উদ্যোগে একটি তহবিল গঠন করা হয়। এমন উদ্যোগের কথা জানতে পেরে গত ২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় ছাত্রশিবির কর্মীরা গিয়ে তাতে বাধা দেয়। বাংলা বিভাগের খুররম নামের এক শিবিরকর্মী অন্তত ২০ জনের একটি দল নিয়ে এসে বিএনসিসির পুরো ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। এ সময় তারা তহবিলের জন্য তোলা সব টাকা তাদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা কথা জানালে বিএনসিসির সাবেক ইনচার্জ মাসুম জামসেদকে ‘ছাত্রলীগের কর্মী’ ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা করা হয়। ওই সময় তার মোবাইলও চেক করে শিবিরকর্মীরা।
ঘটনার শিকার মাসুম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু ছেলে আমার মোবাইল চেক করে। ওদের আমি চিনি না। এর মধ্যে আমি কলেজেও কম গিয়েছি। নতুন অনেককেই চিনি না। তবে আমার সঙ্গে বেশি কিছু হয়নি। শুনেছি ওসমানকে মারধর করেছে। তবে কারা কেন করেছে এই বিষয়ে আমার ধারণা নেই।’
পরে ২৮ আগস্ট ‘মহসিন কলেজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি পেইজে এজিএম বাপ্পী নামের একজন ছবি দিয়ে জানান, ‘বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য চট্টগ্রাম জেলা কেন্দ্রীয় তহবিলে মহসিন কলেজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা প্রদান করেন মহসিন কলেজ সমন্বয়কবৃন্দ।’
বুধবার (১১ আগস্ট) দুপুরে মহসিন কলেজের ইংরেজি বিভাগের ক্লাস কক্ষে হামলা চালায় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় এক নারী শিক্ষার্থী আহত হন। ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নকিবকে বেধড়ক পেটানোর পর একপর্যায়ে তার হাতের নখও তুলে ফেলা হয়েছে।
অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার মৌখিক পরীক্ষার জন্য কলেজে গেলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। জানা গেছে, হামলার ভয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী মৌখিক পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিতে পারেনি।
কলেজের ছাত্রদলকর্মী আবির আহমেদকে পেটানোর পর একপর্যায়ে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। আবিরকে পেটানোর কথা ‘গণধোলাই’ সাজিয়ে ফেসবুকেও পোস্ট দিয়ে জানান ছাত্রশিবির নেতা এজিএম বাপ্পী। তার ওই পোস্টে শিক্ষার্থীদের মোবাইল চেক করার প্রমাণও মিলেছে।
মহসিন কলেজের এক শিক্ষার্থী পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কলেজে এখন যাকে তাকে ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে মোবাইল চেক করা হচ্ছে। হুমকি দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে কলেজে আসতে দিচ্ছে না। এসব ঘটনার কথা শিক্ষকদের জানালে তারা নিরব ভূমিকা পালন করছেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ কলেজের সমন্বয়কদের জানাতে বলে দায় সারেন।’
অন্য এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘কলেজে তারা সবার মোবাইল চেক করে। সাধারণ শিক্ষার্থী বললে মানতে চায় না। তারা বলে সাধারণ শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই। কিছু না কিছুর সঙ্গে জড়িত আছোস।’
এসব হামলার জন্য এজিএম বাপ্পী নামে রসায়ন বিভাগের একজনকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগী ও কলেজ শিক্ষার্থীরা। ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হলেও তার নেতৃত্বেই এসব হামলা হচ্ছে বলে অভিযোগ হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি, ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ের আড়ালে বাপ্পী শিবিরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাপ্পীর অংশগ্রহণের প্রমাণ ছাড়াও অনুসন্ধান করে শিক্ষার্থীদের দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। আবার চট্টগ্রামভিত্তিক কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কথায়ও একই আভাস পাওয়া গেছে।
এছাড়া হামলার নেতৃত্বে আনোয়ার নামে অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া গেছে। তিনিও শিবিরকর্মী বলে জানা গেছে।
এজিএম বাপ্পীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে শিক্ষার্থী নিপীড়নের অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমাকেও কেউ বলতেছে সে শিবির পরিচয় দিয়ে মারধর করছে, কেউ বলতেছে আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে করছে। এখন আন্দোলনকে কলুষিত করতে অনেকেই অনেক কিছু করছে।’
তবে হামলা ও নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে এজিএম বাপ্পী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাই, ক্লাশ করি। অনেক সময় দেখা যায়, এমন হামলার সময় আমি কাউকে বাঁচাতে গেছি বা পাশ দিয়ে যাচ্ছি। ভিডিও দেখে অনেকে মনে করছেন, এগুলোর সঙ্গে আমিও জড়িত। প্রকৃতপক্ষে আমি কোনো হামলার সঙ্গে জড়িত নই। বরং আমি দুটি ছেলেকে সাধারণ ছাত্রদের হাত থেকে বাঁচিয়েছি।’
বাপ্পী বলেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ভাইভা পরীক্ষা চলছে। ছাত্রলীগের সময়ে যারা বিভিন্ন শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তারা এখন ভাইবা দিতে আসা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে। আগে যারা সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন করেছে, এখন অনেকে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক আগে শিবিরকর্মী ছিলাম। কিন্তু আমি এরপর আর শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হইনি। তবে এটা ঠিক যে, আমার একটা সার্কেল শিবিরের সঙ্গে জড়িত।’
৮ বছর ধরে ছাত্রলীগও ছিল বেপরোয়া
এর আগে গত আট বছর ধরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ছাত্রলীগের ছিল একাধিপত্য। ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ছাত্রশিবিরকে হটিয়ে কলেজটি দখলে নেয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে বছরের পর বছর ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা কলেজটিতে রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। সর্বশেষ গত ৬ মে মহসিন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সিপি