সবুজ পতেঙ্গা এখন সাদা-সিমেন্টের শহর: চাষের জমি উধাও, বিষে ভরা পুকুর, ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ
১৩টি দুর্যোগে বিপর্যস্ত, উন্নয়নের ছোবলে বিপন্ন
এক সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গার নাম উচ্চারণ করলেই চোখে ভেসে উঠত সবুজ বন, খোলা মাঠ, খালে ভেসে থাকা মাছ আর উপকূলঘেঁষা চিংড়িঘেরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ছিল মৌসুমি তরমুজের সুখ্যাতি, শীত-গ্রীষ্মের নানান সবজি আর লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ। এককথায়, প্রকৃতির এক অনন্য নিদর্শন ছিল এই অঞ্চল। কিন্তু আজ সেই পরিচিত দৃশ্য কেবল স্মৃতিতে। গত তিন দশকে তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর যান্ত্রিক জোয়ারে বদলে গেছে পুরো এলাকার চেহারা। বিলীন হয়েছে ফসলি জমি, হারিয়েছে জীববৈচিত্র্য। উন্নয়নের গল্প মানুষ বলছে গর্বভরে, কিন্তু প্রকৃতি কাঁদছে নীরবে।

১০ বছরে বিলুপ্ত ৭৫৫ হেক্টর ফসলি জমি
২০১৫ সালে পতেঙ্গা, ইপিজেড ও বন্দর এলাকায় ফসলি জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৯৪৫ হেক্টরে। অর্থাৎ, এক দশকে হারিয়েছে ৭৫৫ হেক্টর জমি। বাণিজ্যিক স্থাপনা, ডিপো ও কারখানা গড়ে ওঠায় এই জমি হারিয়ে গেছে চিরতরে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও এখানকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে এসে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯৪৫ হেক্টরে—অর্থাৎ এক দশকে হারিয়েছে ৭৫৫ হেক্টর।

সরেজমিন দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে আউটার রিং রোড থেকে পতেঙ্গা হয়ে ফৌজদারহাট পর্যন্ত একপাশে যেমন সাগর, তেমনি আরেক পাশে সবজির চাষ। গ্রীষ্ম ও শীত—দুই ঋতুতেই এখানে সবজি চাষ করেন কৃষকরা। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো জমিতে এখন গড়ে উঠেছে স্থাপনা। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু জমিতে এখনও চাষ হচ্ছে। এখানে শীতের সবজি, লালশাক, টমেটোর চাষ করা হয়েছে।

এছাড়া বিমানবন্দর এলাকার সেবার বিল ও পতেঙ্গা সি-বিচ এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে রোডের মুখেই রাস্তার একপাশে পরিত্যক্ত পড়ে রয়েছে কয়েক হেক্টর জমি।

চট্টগ্রামের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পতেঙ্গার ১,২০০ জন কৃষক চাষাবাদের কাজ করেন। এবারের রবি মৌসুমে (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) ৭,২০০ মেট্রিক টন সবজি ও ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পতেঙ্গা জোনের মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা পার্বতী রানী মিত্র বলেন, ‘চট্টগ্রামে ফসলি জমিতে গৃহনির্মাণ ও কল-কারখানা স্থাপনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি। ২০১৫ সালে ১,৭০০ হেক্টর আবাদি জমি ছিল, ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৯৪৫ হেক্টরে। এছাড়া দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায় এক সময়ের ফসলি জমি অধিগ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের বিভিন্ন প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে আবাদি জমিগুলো বিলুপ্ত হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ছাদবাগান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে শহরের বাড়ির ছাদে বিষমুক্ত সবজি ও ফলচাষে এগিয়ে আসছেন অনেক মালিক।’

বর্জ্য-পানিতে সবজি চাষ, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্যান্য সময় খাল-নালার দুর্গন্ধযুক্ত পানিই একমাত্র ভরসা কৃষকদের। বন্দর, ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকায় বেশিরভাগ আবাদি জমির আশপাশে পুকুর, গভীর নলকূপ ও জলাধার নেই। বাধ্য হয়ে এখানকার কৃষকেরা বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্যমিশ্রিত নালা-নর্দমার এসব নোংরা পানি ব্যবহার করছে চাষের কাজে। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

কৃষকদের জন্য পানির বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে সেক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিএডিসির। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পতেঙ্গায় কোনো সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি সংস্থাটি।
সরেজমিন দেখা গেছে, কৃষকরা চাষের জমির পাশেই ছোট একটি কূপের মতো করেছে। খালের সঙ্গে সংযোগ করে দেওয়া হয়েছে কূপের। সেই কূপ থেকেই মোটরের মাধ্যমে পানি দেওয়া হচ্ছে সবজির খেতগুলোতে।

পতেঙ্গার এলাকার বাসিন্দা কৃষক মো. ইউসুফ বলেন, ‘এসব এলাকায় জমির মাটিতে লবণাক্ততা, খালের পানিতে কারখানার বর্জ্য ফেলার কারণে আমাদের চাষাবাদ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এখানে পানি সেচের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই বাধ্য হয়ে আমরা খালের নোংরা পানি ব্যবহার করি। কিন্তু এখন খালের পানিও চাষাবাদের উপযুক্ত নয়। তাই বৃষ্টির ওপর আমাদের ভরসা করতে হয়। অনেক সময় তীব্র গরম ও বাতাসে লবণের আর্দ্রতার জন্য ফসল জ্বলে যায়।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পতেঙ্গা জোনের মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা পার্বতী রানী মিত্র বলেন, পতেঙ্গা জোনের কৃষকদের চাষাবাদে সেচ সুবিধার জন্য সরেজমিন পরিদর্শন করতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) পক্ষ থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বিজ্ঞানী কর্মকর্তা ড. মো. সহিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘১৯৯১ সালের বন্যার পর পতেঙ্গার মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ফলে এর পর থেকে ফসল উৎপাদন কম হয়। আমাদের মাটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কোন কোন ফসল এখানে উৎপাদন হবে। বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্যের দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে। ২০২৪ ও ২৫ সালের গবেষণায় আমরা পতেঙ্গার ফসল উৎপাদনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।’
কমছে মাছ-চিংড়িঘের, হারিয়ে যাচ্ছে কাঁকড়া
সরেজমিন পতেঙ্গা-ইপিজেড-বন্দর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পতেঙ্গার নেভাল থেকে শুরু করে সি-বিচ, চরপাড়া, জেলেপাড়া, গঙ্গাঘাট, খেজুরতলা, আকমল আলী রোড, আনন্দবাজার, হালিশহর, কাট্টলী ও সাগরিকা এলাকায় প্রায় ১২০টির বেশি মাছ ও চিংড়িঘের ছিল। বর্তমানে কমতে কমতে সে সংখ্যা এখন ৪০। আগে যেখানে প্রতিটি ঘেরে বছরে ১০–১৫ লাখ টাকার মাছ-চিংড়ি বিক্রি হতো, এখন তা কমে প্রায় ৮ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। সব এলাকাতেও কাঁকড়ার সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে—প্রায় বিলুপ্তির পথে। অথচ একসময় কাঁকড়া শিকার করে এলাকার অনেকের পরিবার চলতো। মূলত ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন মাছ ও চিংড়িঘের বিলুপ্ত হচ্ছে। আকমল আলী রোডের বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি ঘেরে এখনও মাছ ও চিংড়ি চাষ হয়। কিন্তু আগামী কোনো ঘূর্ণিঝড় হলে সেগুলো বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মাইজপাড়া মাসুম ফকির জামে মসজিদের সহ-সভাপতি মো. ইউচুফ জানান, “আমার তিনটি চিংড়িঘের ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের বন্যার পর ৩৫ বছরে পতেঙ্গার চিত্র এভাবে পাল্টে যাবে কখনও ভাবিনি। একদিকে যেমন এলাকার উন্নয়ন হয়েছে, অন্যদিকে আমরা হারিয়েছি মাঠভরা ফসল, পুকুর—জলাশয় ও সাগরের মাছ। এখন চোখে পড়ে না সাগরের কোরাল, কালা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, বোয়াল, খরুল ও মোড় বাটা মাছ। দেশী মাছ তো একেবারেই বিলুপ্ত। হারিয়েছি ফসলের ক্ষেতও।”
পুকুর ভরাট, গাছ নিধনে দেশি মাছ প্রায় নেই
কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে কমছে মাছ আহরণ। আগে বিভিন্ন এলাকায় পুকুর, ডোবা থেকে শুরু করে বর্ষার দিনে ফসলি বিলেও মাছ শিকার চলতো—যা এখন শুধুই স্মৃতি। মূলত গাছপালা কাটা ও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের কারণে দেশীয় মাছ আহরণ একেবারেই নেই বললেই চলে।
এছাড়া বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফসলি জমি থেকে শুরু করে খালে গিয়ে পড়ছে। এসব বর্জ্য আবার খাল থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে সাগরে। এর ফলে আগে উপকূলীয় এলাকায় যেভাবে মাছের দেখা মিলতো, এখন তার সিকিভাগও নেই। এসব কারণে অনেক জেলে মাছ আহরণের পেশা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
দূষণ ও মাছ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে উত্তর চট্টগ্রাম উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লিটন দাস বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরে এখন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। মাছের আশায় জেলেরা যেখানেই জাল ফেলছে, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে জেলিফিশ। সাগরে দূষণের কারণে মাছের স্বাদ নষ্ট হচ্ছে। সাগরে কলকারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক দ্রব্য ও পলিথিন মৎস্য প্রজননের স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। পলিথিনে আটকে অনেক রেণু পোনা নষ্ট হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া সমুদ্রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারের নিয়ম ৪০ মিটারের বাইরে মাছ আহরণ। কিন্তু তারা ১৫ থেকে ২০ মিটারের ভেতরে নিয়মিত মাছ আহরণ করছে। এতে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে।’
দিন দিন মাছ আহরণ কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে লিটন দাস বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে দক্ষিণ পতেঙ্গা পর্যন্ত ৮টি থানার ৩৮টি গ্রামের প্রায় ২২ হাজার স্থানীয় জেলে মৎস্য শিকার করেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে দিন দিন মাছ আহরণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া বন্দরের আনন্দবাজার এলাকায় বে-টার্মিনাল চালু হলে বন্দর থেকে কাট্টলী পর্যন্ত কর্মসংস্থান হারাবে ১০ হাজার জেলে পরিবার।’
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়ার বড় কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। সাগরে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় জেলিফিশের প্রভাব বেড়ে গেছে। জেলিফিশ সাগরের ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলছে। ফলে ছোট মাছগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাচ্ছে। সাগরের মাছ নিরূপণ করার জন্য আমাদের একটা অনুসন্ধানী জাহাজ আছে। তাতে দেখা গেছে, সাগরের তলদেশে মাত্র ২০০ মিটারের মধ্যে প্লাস্টিক মিলছে। এছাড়া কল-কারখানার রাসায়নিক তরল পদার্থ ও মানববর্জ্যের কারণেও হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। দেশীয় মাছ শুধু পতেঙ্গা থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে, এমন না—এমন চিত্র অহরহ। তবে দেশীয় মাছ উৎপাদন বাড়াতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের পরিচালক (উপসচিব) নাসিম ফারহানা শিরীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম ইপিজেডের ১৩১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইউনিটসহ ১৪৭টি কারখানা ওই ইটিপির সঙ্গে যুক্ত। কিছু কিছু কারখানায় কোনোপ্রকার পরিশোধন ছাড়াই রাসায়নিক তরল বর্জ্য সরাসরি খালে বাইপাস করছে। যা পরে পতেঙ্গা এলাকায় সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি পানিও দূষিত হচ্ছে। পানি দূষণের কারণে একদিকে যেমন কৃষি জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সাগরের মাছেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা সব সময় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই না, কারণ কিছু কিছু কারখানা এখনও ইটিপির সঙ্গে যুক্ত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, মানববর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনের দেখভাল করার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার।
উন্নয়নের কোপে গাছগাছালি উজাড়
গত ১০ বছর আগেও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও আশপাশের এলাকা গাছগাছালি ও বনাঞ্চলে ঘেরা ছিল। কিন্তু উন্নয়নের কোপে এসব বনাঞ্চল বিলীন হয়ে গেছে। সমুদ্রের কোলঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বনও এখন আর নেই। সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালে রাসমণিঘাট থেকে শুরু করে আনন্দবাজার, চরপাড়া ও খেজুরতলা ইপিজেড, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় ২০ হাজার গাছ কাটা হয়। এসব গাছের গড় বয়স ছিল ১২ থেকে ১৩ বছর।
নগরীর পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত চার লেনের রিং রোড নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৩,৩২২ কোটি টাকা। এ সড়ক বানাতে গিয়েই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়ানো এসব গাছ কেটে ফেলা হয়।
একইসঙ্গে এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পতেঙ্গার কাটগড় থেকে পূর্বের সি-বিচ মোড় পর্যন্ত সড়কে তিন সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির কয়েক হাজার গাছ কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে কতটি গাছ কাটা হয়েছে, এ হিসেবে নেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), বন বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশনের কাছে।
সর্বশেষ র্যাম্পের জন্য ফ্রি-পোর্টের মূল সড়ক থেকে বেপজার ভেতরের গেট পর্যন্ত ৪৫টি গাছ কেটে ফেলেছে সিডিএ। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) মূল ফটক থেকে ফ্রি-পোর্ট মোড় পর্যন্ত নির্মিত হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার দুটি র্যাম্প।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন শামস বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় বন বিভাগের হালিশহর বিট কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন, “পতেঙ্গা সি-বিচ থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত রোডের পূর্ব পাশে ১০ সিডি লিংক কিলোমিটার পর্যন্ত ১০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। তবে কাটগড় থেকে নেভাল পর্যন্ত গাছ কাটার বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জানবে। কারণ ফরেস্টের কোনো গাছ সড়কের পাশে লাগানো হয়নি।”
এছাড়া পতেঙ্গা-বন্দর এলাকায় টানেল ও ওয়াসার শোধনাগার নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের কন্টেইনার ডিপো নির্মাণের কারণেও অনেক ফসলি জমি ও গাছপালা বিলীন হয়ে গেছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের সমন্বয়ক পরিবেশবিদ মো. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “চট্টগ্রাম হচ্ছে ইকোনমিক জোন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করতে গিয়ে আউটার রিং রোড, টানেলের জন্য গাছ কাটা, পাহাড় কাটাসহ প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর সমানতালে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন নগর উন্নয়নের নীতিনির্ধারকেরা। জলজ প্রাণী এখন বিলুপ্ত, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতির বিপর্যয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত কম হওয়াসহ ষড়ঋতুতে প্রভাব বিস্তার করবে।”
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেমনি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বেশি সংখ্যক কীট-পতঙ্গ থেকে শুরু করে মাছ-কাঁকড়ার বিভিন্ন প্রজাতি। ইপিজেড-পতেঙ্গার এলাকার চরাঞ্চলে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত হেনেছে। এতে ভেঙেছে উপকূলীয় এলাকা।
১৫ বছর আগে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত যে ম্যানগ্রোভ বন ছিল, সেখানে বক, শালিক, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাস ছিল। একসময় সৈকতের বালিতে ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার দাপট। কিন্তু বর্তমানে এসব কেবলই স্মৃতি। নগরায়ন ও দূষণের যাতাকলে সবকিছুই হারিয়ে গেছে।
কৃষি জমির উর্বরতা কমে গেছে। পানি দূষিত হওয়ার কারণে নেই দেশীয় মাছ। ফসলি জমির উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বও নেই।
তারও আগে পতেঙ্গা-বন্দর এলাকার বনভূমিতে শেয়াল, মেছোবাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বিচরণ ছিল বলেও স্থানীয় বয়স্ক বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা গেছে।
পতেঙ্গা-বন্দর এলাকায় গত দুই দশকে বিপুল পরিমাণের জলাশয় ও পুকুর ভরাট করা হয়েছে। এছাড়া এলাকার পানিপ্রবাহের বেশিরভাগ খালই এখন মৃতপ্রায়।
ইপিজেড এলাকার আকমল আলী ঘাটের বাসিন্দা ৭০ বছরের পাখি জলদাস বলেন, “বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় চরাঞ্চলে এক সময় ব্যাপক ফসলের উৎপাদন হতো। চরাঞ্চলের বুকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল সবুজ ঘাস, যেখানে রাখালেরা পশু পালন করতো। খাল ও চিংড়ি মাছের ঘোনা এবং ম্যানগ্রোভ বনের গাছের গোড়ায় বড় বড় গর্ত থেকে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো অনেকে। তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে মানুষ হাত বাড়ালেই মাছের দেখা মিলতো। এখন ভাঙনের পর সব কিছু বিলীন হয়ে গেছে।”
৩৫ বছরে ১৩ ঘূর্ণিঝড়, ধ্বংস ঘের-জলাশয়
পতেঙ্গা-বন্দরের উপকূলীয় এলাকায় ৩৫ বছরে ১৩টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে পতেঙ্গা উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে। ওই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভেসে গিয়েছিল ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের, লাখ লাখ গবাদি পশু। এরপর থেকেই এসব এলাকার জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। তবে এরপর থেকে আরও এক ডজন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও অত বেশি ক্ষতি হয়নি।
পরের ১২টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০১৩ সালে ‘মহাসেন’ উপকূলে আঘাত হানে। তবে এর মধ্যে মহাসেনের তাণ্ডবে জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধের আশপাশে ও বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৫ সালে ‘কোমেন’ আঘাত হানলে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ২০১৬ সালে ‘রোয়ানু’র কারণে ইপিজেড-পতেঙ্গার বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রায় ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ওই সময় দুই বাসিন্দা নিখোঁজ হন। রোয়ানুতে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও জেলেপল্লীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
২০১৭ সালে উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’, ২০১৯ সালে ‘বুলবুল’ এবং ২০২০ সালে সুপার সাইক্লোন ‘আমফান’ আঘাত হানে। তবে এসব ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশি মাশুল গুণতে হয়নি এখানকার বাসিন্দাদের।
২০২২ সালে তাণ্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’, ২০২৩ সালে উপকূলে আঘাত হানে ‘মোখা’। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ চট্টগ্রামের ইপিজেড-পতেঙ্গার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এতে আকমল আলী রোডের জেলেপল্লীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
দুর্যোগে বিপর্যস্ত, উন্নয়নে বিধ্বস্ত
উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি অদ্ভুত সমন্বয়ে পতেঙ্গার পরিবেশ এখন বিপর্যয়ের মুখে। ৩৫ বছরে ১৩টি ঘূর্ণিঝড়, গাছপালা উজাড়, দূষিত বর্জ্য এবং মাছ চিংড়িঘেরের সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনায় পতেঙ্গার আগের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের জীবনধারণের জন্য এখন একাধিক সংকটের সম্মুখীন, যা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। এজন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে প্রকৃতি এবং মানুষের উন্নয়ন একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। উন্নয়নের নামে পতেঙ্গায় যা ঘটছে তা নিছক এলাকা বদলের গল্প নয়, বরং এটি একটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের নীরব চিত্র। প্রাণের উৎস ভূমি, পানি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না—এ সতর্ক বার্তা এখন প্রকৃতি নিজেই দিয়ে যাচ্ছে।
ডিজে