অনিরাপদ/ সন্ধ্যা নামলেই ভুতুড়ে পরিবেশ পতেঙ্গা সৈকতে

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঢাকঢোল পিটিয়ে সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। উপকূলীয় বাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণ নামে এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের ‘সৌন্দর্য’ দেখিয়ে সেটিকে ‘বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর’ প্রমাণের চেষ্টা ছিল তার কন্ঠে। তখন আলোকায়ন, ফুলবাগান ও পরিচ্ছন্ন পতেঙ্গা সৈকত দেখে সিডিএর প্রশংসাও করেছিল নগরবাসী।

তবে ওয়াকওয়ে উন্মুক্ত হওয়ার মাসতিনেকের মধ্যেই এখন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। জুন মাস থেকে সন্ধ্যা নামলেই ভূতড়ে পরিবেশ বিরাজ করে পুরো সৈকত এলাকাজুড়ে। এছাড়া সেখানকার নান্দনিক পরিবেশ নষ্ট করে বসানো হয়েছে ঝুপড়ি দোকানের সারি। ময়লা আবর্জনায় ভরপুর আউটার রিং রোডের সৌন্দর্য। পিডিবি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় সন্ধ্যার পর থেকে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে পতেঙ্গা সৈকত। তবে সৈকতের মূল পয়েন্টে সৌরবিদ্যুৎচালিত কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আলো জ্বলে৤ ইতিমধ্যে অনেকে ছিনতাইসহ নানা বিপদে পড়ছে অনিরাপদ এই সৈকতে এসে। বিষয়টি স্বীকারও করেছে পুলিশ। তাই সৈকতের মূল পয়েন্টে রোববার থেকে বাড়ানো হয়েছে বাড়তি পুলিশ ফোর্স।

প্রসঙ্গত, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে জাইকা। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে চার লেনের এ সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

উপকূলীয় বাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণ নামে এ প্রকল্পের আওতায় ১৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হবে। এর মধ্যে ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার মূল ও ২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে তৈরি করা হবে। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮৬৫ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। দুই বার সংশোধনের পর বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৭২০ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার এবং জাইকার সহায়তা ৭০৬ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৯ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

সাম্প্রতিক সময়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা। তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর জন্য ঢাকডোল পিটিয়ে সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান গত ফেব্রুয়ারি মাসে পতেঙ্গা আউটার রিং রোড দর্শনার্থীদের উন্মুক্ত করে দেন। ওই সময় ফুলের বাগান, আলোকায়ন ও পরিচ্ছন্ন সৈকত দেখে দর্শনার্থীরা সিডিএর প্রশংসা করলেও সেই সুনাম বেশি দিন টেকেনি। মাসতিনেক যেতে না যেতেই অপরিচ্ছন্নতায় ভরে গেছে সৈকত। ফুলের অনেক বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। যততত্র বসানো হয়েছে ঝুপড়ি দোকান।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৪০টির বেশি খুঁটিতে বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হলেও তা ৩০ জুন থেকে অচল হয়ে আছে। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন বকেয়া বিল বাকি থাকায় বিছিন্ন করে সৈকতে লাগানো ৪০টি সড়কবাতির বৈদ্যুতিক সংযোগ। ফলে সন্ধ্যা নামলেই ভূতড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে সিডিএর নবনির্মিত সমুদ্র সৈকত। এই সুযোগে সেখানে যাওয়া দর্শনার্থীরা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। দীর্ঘ সাড়ে তিন কিলোমিটারের সমুদ্র সৈকতে আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে হিমসিম খাচ্ছে পতেঙ্গা থানা পুলিশও। ফলে তারা বাধ্য হয়ে নগর পুলিশের বিশেষ শাখায় বাড়তি পুলিশ চেয়ে আবেদন করে। থানা পুলিশের সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে রোববার (১৮ আগস্ট) থেকে বাড়তি পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।

পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘গত জুলাই মাস থেকে সৈকতে সন্ধ্যা নামলেই বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে দীর্ঘ সাড়ে তিন কিলোমিটার সৈকতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের বেগ পোহাতে হয়। এরই মধ্যে সৈকতে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকারও হয়েছেন। সৈকতের আলোকায়ন করার দায়িত্ব সিডিএর হলেও কোনও অঘটন ঘটলে দায় কিন্তু আমাদের ওপরই বর্তায়। তাই আমরা ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি বাড়তি ফোর্স মোতায়নের জন্য। আজকে (রোববার) থেকে পতেঙ্গা সৈকতে বাড়তি ফোর্স মোতায়ন করা হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিতরণ অঞ্চল চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী (হালিশহর) মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত পরিদর্শনে আসার আগে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিডিএর আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা প্রায় ৪০টি পোলে সড়ক বাতির জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেই। কিন্ত ৩০ মে পর্যন্ত সিডিএর কাছে বিল বকেয়া হয় ২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। তাদেরকে চিঠি দিয়ে ও মৌখিকভাবে বারবার বলা হলেও এই বিল দিতে অপারগতা করে। এমনকি সিডিএর এ খাতে কোনও ফান্ড না থাকার কথা বলে আমাদেরকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করার অনুরোধ করলে আমরা জুনের এক তারিখ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি।’

বিদ্যুৎ বিতরণ অঞ্চল চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন বলেন, ‘সিডিএর অনুরোধে পতেঙ্গা সৈকতের আলোকায়নে বিদ্যুৎ সংযোগ করা হলেও এখন সেই বিদ্যুৎ বিল দিতে অনীহা সিডিএর। আমরা সিডিএ চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি জনসম্পৃক্ত এ প্রকল্পের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চাইনি। তবে সিডিএ নিজ থেকেই যখন সৈকতের বিদ্যুৎ সংযোগ রাখতে চায় না তখন আমাদের করার কী আছে?’

এ প্রসঙ্গে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে উপলক্ষে তাড়াহুড়ো করে বিদ্যুৎ বিভাগ পতেঙ্গা সৈকতে সড়কবাতি লাগিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই সড়কবাতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। আমাদের প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই তখন আমরা বৈদ্যুতিক সংযোগসহ সড়কবাতি লাগাবো।’

পিডিবি সিডিএর কাছে যে বকেয়া বিল পাওয়ার কথা বলছে সেই প্রসঙ্গে জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘ওই সময় তো আমরা এসব বাতি লাগাইনি। পিডিবিই এসব বাতি লাগিয়েছিল আর আমাদের এই খাতে কোনও বরাদ্দ নেই।’

তবে পিডিবির হালিশহর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন বলছেন, ‘সিডিএর আবেদনের প্রেক্ষিতেই শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংযোগটাই দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রায় ৪০টির মত বৈদ্যুতিক খুঁটি ও সড়কবাতি সবই সিডিএ স্থাপন করেছে।’

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!