সন্দ্বীপের ওসির ফোনালাপ ভাইরাল, পুলিশের ভূমিকা বদলে দিচ্ছে দৃশ্যপট
মিতা সমর্থকদের মার খেয়েও রুখে দাঁড়াচ্ছে জামালের কর্মীরা
‘যার যার স্বাধীনতা আছে, সে তার মতো ভোট দেবে। তার মতো চলবে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে নৌকার মিছিল করে গেছেন। এখানে তাদের (স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী) ওপরে কেন এগুলো (হামলা) হল?’— এভাবেই আওয়ামী লীগ নেতা এক ইউপি চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে মোবাইলে বলছিলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন। ওসির সেই ফোনালাপের একটি রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সেই ফোনালাপে ওসি নৌকা প্রার্থীর সমর্থক এক নেতাকে বলেন, ‘আজকে শুরু হইছে (প্রচারণা)। কাউকে প্যারা দেবেন না। কাউকে এখানে কাউন্ট করার সুযোগ নাই। সিইসি মহোদয় যেভাবে বলে কাজ সেভাবে হবে। কোন ব্যক্তিবিশেষের কাজ হবে না কিন্তু বলে দিলাম।’
সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সন্দ্বীপের শিবেরহাটে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবীবুল আওয়ালের বাড়িও এই ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম পনিরের নেতৃত্বে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছেন ডা. জামাল। পরে জামালের কর্মী-সমর্থকরা একত্র হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পনির চেয়ারম্যান ও তার অনুসারীরা ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েন।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারিকাইতের শিবেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহফুজুর রহমান মিতার সমর্থনে মিছিল ছিল সোমবার বিকেলে। অন্যদিকে একই দিন সন্ধ্যায় জামাল উদ্দিনের সমর্থনে মিছিল হওয়ার কথা ছিল। নৌকার সমর্থকরা আগের কর্মসূচি অনুযায়ী বিকেলে মিছিল করার পর সন্ধ্যায় যখন ডা. জামালের সমর্থকরা পূর্বনির্ধারিত মিছিল বের করে, তখন ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম পনিরের নেতৃত্বে আবার মিছিল বের করে নৌকার সমর্থকরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময় ডা. জামাল উদ্দিনের মিছিলটি রাস্তার এক পাশে সরে নৌকার মিছিলকে জায়গা করে দেয়। ডা. জামালের মিছিলটি একটু বড় হওয়ায় সেটিকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় শেষ প্রান্তে জামাল উদ্দিনের কয়েকজন কর্মীকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে নৌকার কর্মীরা। এ সময় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলে হঠাৎ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে এমন ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সন্দ্বীপ থানার ওসি কবির হোসেন। তিনি সেখান থেকে ইউপি চেয়ারম্যান পনিরকে ফোন করেন। সেই ফোনালাপই ভিডিও করে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন স্থানীয়রা। তবে ওসির অবস্থানকে নির্বাচনের পরিবেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন স্থানীয় ভোটাররা।
নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে সন্দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার সমর্থকদের হামলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব ঘটনায় পুলিশকে আগের মতো একতরফা নৌকার প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। সাধারণ ভোটাররা এতে প্রশাসনের ওপর কিছুটা হলেও আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) রাতেও উপজেলার এনাম নাহার মোড় ও আলিমিয়া বাজার এলাকায় ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিনের প্রচারণায় হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি প্রচারণা সভায় প্রার্থী ডা. জামাল নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের আলি মিয়ার বাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে তার অনুসারীরা জনসংযোগ ও মিছিল করে। এ সময় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সচিব মাহিদুল শিকদার জিকু ও উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য সোহাগ শিকদারসহ ১০-১৫ জন ওই মিছিলের মাঝখানে ঢুকে নৌকার পক্ষে স্লোগান দেন। এস ময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন বাধা দিলে দুই পক্ষ বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এ সময় হাতাহাতির ঘটনায় কাদের নামে একজন আহত হন।
একই সময় উপজেলার এনাম নাহার মোড় এলাকায় আরও একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেখানে ডা. জামাল উদ্দিন নিজে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। এর একপর্যায়ে হারামিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তুহিন ঘটনাস্থলে এসে নৌকার পক্ষে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা বাধা দিলে শুরুতে ধাক্কাধাক্কি এবং পরে একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তুহিনকে সরিয়ে দেয়।
এর আগে প্রচারণা শুরুর প্রথম দিনে সোমবার সন্ধ্যায় শিবেরহাট বাজারে একই কায়দায় ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘অনিয়ম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের সর্বস্তরের মানুষ ও নির্যাতিত রাজনৈতিক কর্মীরা এক হয়েছে। তাদের দাবিতে আমি নির্বাচন করছি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসী পরিকল্পিতভাবে আমাদের প্রতিটি মিছিলে কর্মসূচিতে গায়ে পড়ে হামলা করছে। তারা মানুষকে আতংকিত করতে চায়। এরা বেশিরভাগই কিশোর গ্যাং সদস্য। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট হবে। আমরা নির্বাচনের সুন্দর পরিবেশ ধরে রাখতে সবার সহযোগিতা চাই।’
সন্দ্বীপ উপজেলা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক ফজলুল করিম মিনহাজ বলেন, ‘ওসির এই অবস্থান ভাল লেগেছে। সবাই খুব খুশি। মনে হচ্ছে প্রশাসন সুষ্ঠু ভোট করার বিষয়ে আন্তরিক।’
অন্যদিকে অনেকেই এখনও আস্থার সংকটে রয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সন্দ্বীপের একজন ভোটার বলেন, ‘কিছুদিন আগে সন্দ্বীপে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপ নির্বাচন হয়েছে। দুই নির্বাচনেই প্রশাসন খুব জোর গলায় বলেছিল অবাধ সুষ্ঠু ভোট হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সব নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ভোটের ফলাফল বর্জন করে ভোট চোর শ্লোগান দিয়ে মিছিল হয়েছে। এসব কারণে এখনও পুরোপুরি এই আস্থা পাচ্ছি না যে, শেষ পর্যন্ত প্রশাসন এই অবস্থায় থাকবে।’
এমন আস্থাহীনতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘মানুষ যদি এই ধরনের মানসিকতা রাখে আমরা সেটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছি। মঙ্গলবার থেকে আমরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছি। শুরুতে সন্দ্বীপে গিয়েছি। সেখানকার আটজন প্রার্থীর সবাই ছিলেন। তাদের সবার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। অভিযোগ শুনেছি, সেসব এড্রেস করেছি। তারা আশ্বস্ত হয়েছে। আমরা আশা করছি যে এসব যখন পত্রপত্রিকায় আসবে মানুষ যখন জানবে, প্রার্থীরাও যখন দেখবে যে আমরা সবাইকে সমান সুযোগ দিচ্ছি তারাই ভোটারদের নিয়ে আসবে। নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করার জন্য যা যা করণীয় আমরা করছি।’
সিপি