সন্তানদের মুখ দেখতে চাননি চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা খুনে ফাঁসিতে ঝোলা দুই আসামি

ফাঁসির পর দুই লাশই চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে

মঙ্গলবার (৮ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকেই চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী আমবাগানের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রেলওয়ে কর্মচারী শফিউদ্দিনের দুই খুনির ফাঁসি কার্যকর হল কুমিল্লা কারাগারে। রাতে একইসঙ্গে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলা এই দুজন হলেন— শিপন হাওলাদার ওরফে শিপন এবং নাইমুল ইসলাম ওরফে মঈন। ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ নাছির উদ্দিন ও সিরাজ মিয়া। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে চট্টগ্রাম নগরীর আলোচিত এই খুনের ঘটনার বিচার শেষ হতে লেগেছে সাড়ে ১৭ বছর।

কুমিল্লা কারাগারের সামনে লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা।
কুমিল্লা কারাগারের সামনে লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, ফাঁসি কার্যকরের পর ময়নাতদন্তসহ কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর দুজনের মরদেহ কারাগারের ব্যবস্থাপনায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে ফাঁসির পর দুই লাশই চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে বলে কারাগারসূত্রে জানা গেছে।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে ফাঁসির আগে দুজনকে গোসল করানোর পর তওবা পাঠ করান কারা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা হাফেজ মো. জোনাইদ। পরে তাদের পছন্দের খাবার খাওয়ানো হয়। দুজনেরই শেষ ইচ্ছা ছিল নান রুটি ও গরুর মাংস খাওয়া। সে অনুযায়ী তাদের সেসব খাওয়ানো হয়েছে। তারও আগে কারাবিধি অনুসারে বিকাল ৫টা এবং সর্বশেষ রাত ৯টার দিকে কারাগারের সহকারী সার্জন ডা. রেজা মো. সরোয়ার আকবর দুই দফায় দুজনেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমানসহ অন্য কারারক্ষীরা। ফাঁসি কার্যকর করার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসাইন, জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ, জেলার আসাদুর রহমান।

মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কারাগারে এসে দণ্ডপ্রাপ্ত শিপনের সাথে তার মা-ভাইসহ ৩ জন এবং ইমনের সাথে তার ভাই-বোনসহ ৩ জন সর্বশেষ দেখা করে তারা প্রায় ২০ মিনিট কথা বলেন। এ সময় শিপন ও ইমন দুজনই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই দিন কনডেম সেলে দুজনই নামাজ ও কোরআন শরীফ পড়ে সময় পার করেন।

শিপন হাওলাদার (বন্দি নং ৫০৭৯/এ) চট্টগ্রাম নগরীর খুলশীর দক্ষিণ আমবাগানের প্রয়াত ইউনুছ হাওলাদারের ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নন্দনসার গ্রামে। অপরজন নাইমুল ইসলাম ইমন (বন্দি নং ৫৭৩৮/এ) চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার ডেবারপাড় এলাকার ঈদুন মিয়া সরকারের ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর পূর্বপাড়ায়।

জানা গেছে, ফাঁসিতে ঝোলা দুই আসামিই তাদের ছেলেমেয়েদের কারাগারে আসতে নিষেধ করে দেন আগেই। এমনকি স্বজনরাও তাদের দেখতে আসুক— সেটাও চাননি তারা। দুজনেই কারারক্ষীদের জানিয়েছেন, তারা চান না তাদের ছেলেমেয়েদের কেউ খুনির ছেলে বলে অপবাদ দিক। তাদের গায়ে যেন এই অপবাদ না লাগে, সেজন্য ছেলেমেয়েদের কারাগারে আসতে নিষেধ করে দেন তারা।

তবে এরপরও সোমবার (৭ মার্চ) রাতে ১৯ স্বজন এসে কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করে যান। মঙ্গলবার (৮ মার্চ) ফাঁসির দিনে দেখা করার সুযোগ ছিল বাবা-মা ও সন্তানদের। কিন্তু দুই আসামিই নিষেধ করে দেওয়ায় সন্তানরা আর বাবাকে দেখতে আসেননি।

কারাগারসূত্রে জানা গেছে, ফাঁসির আগে শেষের দিনগুলোতে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে বসে পরিবারের গল্প করতেন দুজনই। স্মৃতিকাতর হয়ে নিজেদের দোষারোপ করতেন। একপর্যায়ে সবার কাছ থেকে তারা নিজেদের আলাদা করে নেন। সবসময় চুপচাপ থাকতেন।

যাকে হত্যার দায়ে দুজনকে ফাঁসিতে ঝুলতে হল, সেই শফিউদ্দিন ছিলেন রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী-১ চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী। এছাড়া তিনি স্থানীয় রেলওয়ে আমবাগান এলাকার আইনশৃংখলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক এবং জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রাম নগরীর খুলশীর উত্তর আমবাগান রেলওয়ে কোয়ার্টারের ৩৬/এ বাসায় গুলি করে খুন করা হয় শফিউদ্দিনকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় শিপন, ইমন, হেলাল ওরফে জিএস হেলালসহ সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে খুন করেন তাকে। ওই সময় রক্তমাখা শার্ট গায়ে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন শিপন হাওলাদার।

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী মাহমুদা বেগম বাদী হয়ে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২৩ জনের সাক্ষ্য নিয়ে এ হত্যা মামলায় শিপন ও ইমনকে ফাঁসি, সাত আসামিকে যাবজ্জীবন এবং চারজনকে খালাস দেন।

২০০৪ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম আদালতের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আসামির শিপন ও ইমনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এছাড়া হেলাল, ফরহাদ ও মারুফ শিকদারকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. হোসেন হিরণ এবং তার ছেলেসহ ছয়জনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফরহাদ, মারুফ শিকদার সাজা ভোগ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। তবে হেলাল ওরফে জিএস হেলাল এখনও চট্টগ্রাম রেলে টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!