পৌষ সংক্রান্তিতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরমায় শুক্লাম্বর দীঘির পূণ্যস্নান ও মেলায় ছিল লাখো মানুষের ঢল। আত্মশুদ্ধি, পাপমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে প্রাচীন মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে আসেন পুণ্যার্থীরা। প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে সনাতনীদের এই ধর্মীয় উৎসব যেন কোনো সামাজিক উৎসব।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরমা বাইজুরির শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য দীঘির আশপাশে দেখা গেছে এমন চিত্র।

মন্দির প্রাঙ্গণে কেউ অশ্বত্থ গাছে নিচে কবুতর উড়িয়ে, কেউ গাছে ডালে সুতা বেঁধে, আবার কেউ বা তীব্র শীত উপেক্ষা করে শুক্লাম্বর দীঘির জলে স্নান করে মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করছেন। দীঘির চারপাশে লাখো পূণ্যার্থীর ভিড়। আশপাশের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে বাহারি পণ্যের মেলা।

চন্দনাইশ উপজেলার বরমা বাইনজুরী এলাকার শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর পীঠ মন্দিরটি সনাতনী সম্প্রদায়ের প্রাচীন তীর্থস্থান। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্যের নাম অনুসারে এ মন্দিরের নামকরণ করা হয়।

জানা গেছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে ভারতের নদিয়া এলাকায় শুক্লাম্বর ভট্টাচার্যের জন্ম। ৪০ বছর বয়সে সনাতন ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চন্দনাইশের বরমায় আসেন তিনি। বরমায় বেশ কিছু জমি কিনে শিবমন্দির তৈরির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার ও জনসেবা শুরু করেন।
মন্দিরের সম্মুখেই শুক্লাম্বর দীঘির অবস্থান। প্রতি বছর মন্দির প্রাঙ্গণ ঘিরে প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বসে মেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের অসংখ্য মানুষ এই মেলায় অংশ নেন। আশেপাশের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা যায় মেলার ছাপ।
মেলার একদিন আগে সোমবার বিকাল থেকেই দূর-দূরান্তের পূজারী, পুণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী ও দোকানীদের মেলা প্রাঙ্গণে পদচারণা দেখা যায়। মঙ্গলবার সকাল থেকে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। শুক্লাম্বর দীঘি ঘিরে প্রাচীন এই মেলা এদিন পূণ্যার্থীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। পূণ্যার্থীদের পূজা-অর্চনায় মুখরিত হয় শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর মন্দির প্রাঙ্গণ।
মনোবাসনা পূরণে মন্দির প্রাঙ্গণের অশ্বত্থ গাছের ডালে সুতা বাঁধছিলেন নবদম্পতি জয় ধর ও নীলিমা ধর। তারা জানান, অনেকের কাছেই এই মেলার মাহাত্ম্য শুনেছেন আগে, এবার সরাসরি মেলায় অংশ নিতে পেরে খুশি তারা। এছাড়া রাউজান থেকে আসা মিনতি ধর, অজয় চক্রবর্তী ও লোহাগাড়া থেকে আসা নারায়ণ বিশ্বাস জানালেন তাদের সন্তুষ্টির কথা।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, কনকনে শীত উপেক্ষা করেও পাপমুক্ত জীবন লাভের আশায় দীঘির জলে স্নান করতে নেমেছেন নানা বয়সের অসংখ্য নারী-পুরুষ। মেলায় নাগরদোলা, বিভিন্ন ধরনের বেতের তৈরি টুকরি, বড় ঝুড়ি, চালুনি, কুলা, মোড়া, দা-বটি-ছোরা, যাঁতা, মাটির ঘটি-বাটি, শীতের সবজি, মানকচু, শাপলা মাছ, ইলিশ মাছ, পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতের মাছ, চটপটি, বিনি ধানের খই, যব ধানের খই, বাতাসা, গস্যার টফি, বাদামের টফি, নিমকি বিস্কুট, নকুল দানা, কদমা, গজা, নারকেলের চিড়াসহ বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা। রয়েছে বিভিন্ন খাবার ও প্রসাধনীর দোকানও।
শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি উন্নয়ন কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অরুপ রতন চক্রবর্তী ও সদস্য রুবেল দেব জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান এই শুক্লাম্বর দিঘির মেলা। সনাতন ধর্মের মানুষ ছাড়াও প্রতিবছর বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার নারী-পুরুষ মেলা দেখতে আসেন। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় মেলায় পূণ্যার্থীর ভিড় বেশি ছিল। মেলা উপলক্ষে একদিন আগে থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে আসেন নানান বয়সের দেশি-বিদেশি হাজার হাজার ভক্ত।
মেলা পরিচালনা কমিটি ও শুক্লাম্বর দীঘি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব ও সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দু দত্ত জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলাটি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চন্দনাইশ উপজেলা প্রশাসন ও চন্দনাইশ থানা পুলিশসহ সকলে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন।
চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব হোসেন, চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমরান আল হোসাইন, চন্দনাইশ পৌরসভার সাবেক মেয়র আইয়ুব কুতুবী, চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আ ক ম মোজাম্মেল হক, চন্দনাইশ উপজেলা এলডিপির সাধারণ সম্পাদক আকতারুল আলম, চন্দনাইশ পৌরসভা এলডিপির সভাপতি আইনুল কবির বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মেলা পরিদর্শন করেন।
জেএন/ডিজে