শীতেও চট্টগ্রাম অস্থির ডেঙ্গুর দাপটে, একমাসে ৮ জনের মৃত্যু
মশা নিধনের কার্যক্রম আছে ঝিমিয়ে
শীতের মৌসুমেও চট্টগ্রামে কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত দু’দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে দু’জন। এ নিয়ে ডিসেম্বর মাসে মারা গেছে আটজন। মূলত বর্ষা মৌসুমে জমাট পানি থেকে এডিস মশার জন্ম হয়। তখনই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তে হয় মানুষ। কিন্তু গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে এখন শীতেও নিস্তার নেই নগরবাসীর। এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৪১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজার। এরমধ্যে এক ব্যক্তি দু’বার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
তবে চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ফলোআপের ঘাটতির কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একইসঙ্গে রোগের ধরণ পাল্টে যাওয়াও মৃত্যুর বড় কারণ। এছাড়া ডেঙ্গুপরবর্তী জটিলতার মধ্যে আবারও যখন কেউ আক্রান্ত হন তখন তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৯ জন। এ নিয়ে বুধবার (২৮ ডিসেম্বর ) পর্যন্ত আক্রান্ত সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২২ জন। মারা গেছে ৪১ জন।
রোগীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা গেছে, গত ২৬ ডিসেম্বর মারা গেছেন ডাবলমুরিং এলাকার বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী আঞ্জুমান আরা।
আঞ্জুমানের স্বামী ইকবাল বলেন, ‘আমার স্ত্রীর পর পর দু’বার ডেঙ্গু হয়েছিল। প্রথমবার ডেঙ্গুর পর তার কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। আমরা কয়েকবার কিডনি ডায়ালাইসিস করি। কিন্তু এবার ডেঙ্গু ধরার পর কিডনির চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি। হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম দেরিতে। এজন্য আমার স্ত্রীকে বাঁচানো গেল না।’
ডেঙ্গুতে গত ২৪ ডিসেম্বর নগরীর বাকলিয়ার বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী আব্দুল গণি মারা গেছেন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এরপর গত ২২ ডিসেম্বর সদরঘাটের বাসিন্দা সাবরিনা সুলতানা (২১) চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
সাবরিনার বড় ভাই রনি বলেন, ‘আমার বোনের কয়েকদিন ধরে জ্বর, সর্দি, কাশি ছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তির তিনদিন পর ডেঙ্গু টেস্ট করতে দেয়। যেহেতু এখন ডেঙ্গুর সিজন না, তাই আমরা দেরীতে ডেঙ্গু টেস্ট করি। আমার বোনের ডেঙ্গুর পাশাপাশি রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে।’
গত ২১ ডিসেম্বর মারা যায় ২ বছর বয়সী শিশু জান্নাত।
এছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ১৮ বছরের কিশোর বান্দরবানের রোয়াংছড়ির লিয়ান। ৪ ডিসেম্বর মারা যান খুলশীর বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়সী হালিমা। ১ ডিসেম্বর ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ সাতকানিয়ার বাসিন্দা আব্দুল কাদেরও মারা যান চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
জানা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চার ধরনের সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলোর একটিতে সংক্রমিত হলে, সেটির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মালেও অন্য সেরোটাইপগুলো দিয়ে পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। সেরোটাইপ-২ এবং ৩ মস্তিষ্কের প্রদাহের জন্য বেশি দায়ী। তাই ডেঙ্গু ভাইরাস মস্তিষ্কের প্রদাহ বা এনসেফালাইটিস, মেনিনজাইটিস, স্ট্রোকসহ নানান জটিলতা তৈরি করে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. সাহেদ উদ্দিন আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্মাণাধীন ভবন, পানি সংকটের কারণে পানি ধরে রাখার প্রবণতাসহ নানা কারণে শীতের সময়ও মশা জন্মাচ্ছে। এছাড়াও ছাদবাগান অথবা এসির পানিতে এডিস মশা লার্ভা ছড়ায়। যেসব রোগী ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে, ফলোআপ চিকিৎসার ঘাটতিতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। রোগের ধরণ পাল্টে যাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে।’
আরপি ডা. সাহেদ উদ্দিন বলেন, ‘ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। বর্তমান ধরন দেখে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গু এখন আর কোনো মৌসুমের রোগ না। আগে দেখা যেত, শীত মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী তেমন পাওয়া যেত না। কিন্তু রোগের ধরন পাল্টে যাওয়ায় এটি এখন বছরের যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে। আর তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, ‘মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকলেও আগের মত অতটা জোরদার নেই। শীতেও যেহেতু ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তাই আবারও মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করা হবে।’
ডিজে