অডিও/ ক্লাসে শিক্ষকের যৌন হেনস্থা, অপমানে আত্মঘাতে স্কুলছাত্রী

ক্লাসে পড়া পারেনি মেয়েটি। অনেকেই পারেনি। শিক্ষক আতাউর রহমান মোটা বেত এনে মাথা গুণে গুণে পেটালেন প্রায় সবাইকে। মেয়েটির পালা যখন এল, তখন অবাক বিস্ময়ে অন্যরা দেখল আতাউর ছাত্রীটির ইউনিফর্মটা তুললেন নিজ হাতে। এরপর স্পর্শকাতর জায়গায় বেত দিয়ে মেরেই চললেন। মাওলানা আতাউরের আচরণ আগে থেকেই ছিল অশালীন। প্রায়ই তিনি ওই ছাত্রীকে বলতেন ‌‘এমন জায়গায় মারবো কাউকে দেখাতে পারবি না।’ এবার তিনি সেটিই করে দেখালেন।

লজ্জায় অপমানে বিধ্বস্ত ছাত্রীটি বাসায় ফিরে ভেঙে পড়ে কান্নায়। মাকে জানায় ঘটনাটি। মা গিয়ে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমানকে ঘটনাটি জানান। ফল হল উল্টো। সহকারী প্রধান শিক্ষক মেয়েটির ঘাড়েই উল্টো দোষ চাপালেন। তার সঙ্গে যোগ দেন স্কুলের শিক্ষিকা ফারজিয়া বেগম ও স্কুলের আয়া। এ দুজন মা-মেয়ের সামনেই অশ্লীল সব কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এ দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া ওই ছাত্রী। রাগে-ক্ষোভে দৌঁড়ে চলে গেল স্কুলের ছাদে। সেখান থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গুরুতর আহত অবস্থায় এখন তার ঠিকানা হয়েছে হাসপাতালের শয্যা। ওই শয্যাতেই মেয়েটি দিনরাত কান্নাকাটি করছে।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) এমন মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটি মডেল কেজি স্কুল এন্ড কলেজে। ক্লাসে পড়া না পারার অজুহাতে রাঙামাটিতে অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতের নামে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ওই স্কুলের শিক্ষক আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই শিক্ষার্থীকে উল্টো চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে অশালীন মন্তব্য করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ অপমান সইতে না পেরে বিদ্যালয় ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে ওই শিক্ষার্থী। এতে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া ওই শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হলে তাকে প্রথমে রাঙামাটি সদর হাসপাতাল এবং পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) রাঙামাটি মডেল কেজি স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও এখনো গ্রেপ্তার হননি অভিযুক্ত সেই শিক্ষক। এতে দুই শিক্ষক ও এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মামলা নিতে পুলিশ শুরুতে গড়িমসি করে। পরে ঢাকা থেকে কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীর প্রচেষ্টায় পুলিশ মামলা নিলেও যৌন হয়রানির ঘটনা ধামাচাপা দিতে মামুলি ধারায় মামলাটি লিপিবদ্ধ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রাঙামাটি জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি মডেল কেজি স্কুল এন্ড কলেজের কোনো নিবন্ধন নেই। এর ওপর আবার যুক্ত করা হয়েছে কলেজের নাম। প্রধান শিক্ষক মাওলানা এবিএম তোফায়েল উদ্দিন রাঙামাটি জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তিনি জামায়াতের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের জেলা সভাপতি। ওই স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রায় সবাই জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট বলে জানা গেছে।

প্রধান শিক্ষক এবিএম তোফায়েল উদ্দিনের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক আতাউর রহমান (ডানে)।
প্রধান শিক্ষক এবিএম তোফায়েল উদ্দিনের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক আতাউর রহমান (ডানে)।

ঘটনার শিকার মেয়েটির মা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাঙামাটি মডেল কেজি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক আতাউর রহমান তার স্কুল ইউনিফর্ম তুলে ক্লাসের সবার সামনে তলপেটের নিচে আপত্তিজনকভাবে বেত্রাঘাত করতে থাকেন। পেটানোর সময় শিক্ষক বলেছে, “স্কুলে তুই থাকবি, না হয় আমি থাকবো।” বাসায় ফেরার সময় তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। পরে এই ঘটনা আমাদের জানালে তাৎক্ষণিক স্কুলে যাই। আমরা গিয়ে বিষয়টি সহকারী প্রধান শিক্ষককে জানালেও তিনি আমার মেয়েকেই উল্টো দোষারোপ করতে থাকেন। ওই সময় আরেক শিক্ষিকা ও স্কুলের আয়া আমার মেয়ের নামে খুবই অশালীন মন্তব্য করেন।’

ওই মেয়েটির মা বলেন, ‘আমার মেয়ে একপর্যায়ে স্কুলের ছাদে গিয়ে আত্মহত্যা করতে লাফ দেয়। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার মেয়েও হাসপাতালে সারাদিন কান্নাকাটি করেছে।’

হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে ঘটনার শিকার ওই ছাত্রী জানায়, ‘আতাউর রহমানের স্যার আমাকে শরীরের তলপেটের নিচে আপত্তিজনক স্থানে বেত দিয়ে মেরেছেন। এ সময় ক্লাসে অন্যরা হাসাহাসিও করছিল। তার আচরণ ছিল সবসময় অশালীন। তিনি বলতেন, এমন জায়গায় মারবো কাউকে দেখাতে পারবি না। এ বিষয়ে আমার অভিভাবক স্কুলে অভিযোগ করলেও শিক্ষিকা ফারজিয়া বেগম ও স্কুলের আয়া আমার নামে অত্যন্ত অশালীন শব্দ ব্যবহার করেন। এরকম ব্যবহার আর সহ্য করতে না পেরে আমি আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলাম।’

ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার পর তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠায় এলাকাবাসী। প্রত্যক্ষদর্শী অপু দাশ বলেন, ‘আমি দোকানে ছিলাম। চিৎকার শুনে দেখি একটি মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তখন আমার স্ত্রীকে বাসা থেকে ডেকে তার মাথায় পানি দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুলি। এরপর হাসপাতালে পাঠাই। সে পায়ে ও কোমরে আঘাত পেয়েছে।’

রাঙামাটি মডেল কেজি স্কুল এন্ড কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলেন, ‘স্যার যে পড়া দিয়েছিলেন সেটি অনেকে পারেনি। সেদিন স্যার অনেককে মেরেছেন। তবে তাকে (ঘটনার শিকার ওই ছাত্রীকে) স্কুল ইউনিফর্ম তুলে মেরেছেন। কখন যে সে স্কুলের ছাদে চলে গেল আমি দেখিইনি। পরে চিৎকার শুনে নিচে গিয়ে দেখি আমাদের বান্ধবীই নিচে পড়ে আছে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ কথা পুরো রাঙামাটির মানুষ জানে। আমি শিক্ষক হিসেবে তাকে শাসন করেছি মাত্র। আমি শিক্ষকতা করছি আজ পাঁচ বছর। ওই ছাত্রীর অভিভাবকের হামলায় আমিও আহত হয়ে রাঙামাটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। এ ঘটনায় আমি মামলা করতেও চেয়েছিলাম। পরে শুনি তারাই উল্টো আমার নামে মামলা করেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটির কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত করে মামলা রেকর্ড করি। এ মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। রাঙামাটির বাইরে থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাদের গ্রেপ্তারে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

এদিকে অষ্টম শ্রেণীর ওই শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতন ও অপবাদ দেওয়ার প্রতিবাদে রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। রোববার (৪ আগস্ট) সকালের এই মানববন্ধনে এলাকার সাধারণ মানুষ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অংশ নেন। একটি মেয়েকে কতটুকু অপবাদ দিলে তার ওপর কতটুকু শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তা জবাব দেওয়ার জন্য বক্তারা আহ্বান জানান স্কুল কর্তৃপক্ষকে। তারা প্রশ্ন করেন, বর্তমানে হাইকোর্ট থেকে শিক্ষার্থীদের মারধর বন্ধে নির্দেশনা থাকার পরও কিভাবে একটি মেয়েকে অশালীনভাবে মারধর করতে পারে? বক্তারা পুলিশ প্রশাসনের কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী শিক্ষকের বিচার দাবি করেন।

এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে সোমবার (৪ আগস্ট) লোক ভাড়া করে এনে একটি মানববন্ধনের আয়োজন করেন অভিযুক্ত শিক্ষক আতাউর রহমান। জানা গেছে, জামায়াতঘনিষ্ঠ মাদ্রাসা থেকে চাপ দিয়ে কিছু শিক্ষার্থীকেও ওই মানববন্ধনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।

প্রসঙ্গত, ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে ফেনীতে অধ্যক্ষ তার অনুসারীরাও মানববন্ধন করেছিলো। পরে অধ্যক্ষের নির্দেশে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!