শিক্ষকদের যৌন নিপীড়নে বেদনাহত হয়ে আত্মঘাতের চেষ্টা প্রশিক্ষকের
পটিয়ায় প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) প্রশিক্ষণার্থীদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন এক প্রশিক্ষক (ইনস্ট্রাক্টর)। এ ঘটনায় ক্লাস বর্জন করছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। আত্মহত্যা চেষ্টার আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোলা চিঠি লেখেন আত্মহত্যার চেষ্টাকারী প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়া।
শনিবার (৭ মার্চ) বিকেলে অভিযুক্তদের বিচার চেয়ে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ওই ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন প্রশিক্ষণার্থীরা।
দেবব্রত বড়ুয়ার অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের চার প্রশিক্ষক অনেকদিন ধরে প্রশিক্ষণার্থীদের যৌন হয়রানি করে আসছে। এ ব্যাপারে বারবার বলার পরও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, শনিবার ভোররাতে চট্টগ্রাম নগরের নিজ ভাড়া বাসার একটি কক্ষে তিনি ৩০টি ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। পরে পরিবার বিষয়টি অবগত হলে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়া চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার তুলাবাড়িয়া এলাকার মৃত অমূল্য রতন বড়ুয়ার ছেলে। নবীন প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির আইসিটি শাখার প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।
এদিকে, ঘটনার প্রতিবাদে পিটিআই চত্বরে অবস্থান নেন প্রশিক্ষণার্থীরা। তারা অভিযুক্ত চার প্রশিক্ষককে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে না আসার ঘোষণা দেন। ‘ধর্ষণ আর শিক্ষা এক সাথে চলে না।’ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও তুলেন প্রশিক্ষণার্থীরা।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা, পটিয়া থানার ওসি বোরহান উদ্দিন ও ওসি (তদন্ত) জব্বারুল ইসলাম পিটিআই ক্যাম্পাসে গিয়ে আন্দোলনকারীদের জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
দেবব্রত বড়ুয়া শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠিতে সহকর্মী চার প্রশিক্ষককে অভিযুক্ত করেন। অভিযুক্ত চার প্রশিক্ষকরা হলেন- ফারুক হোসেন (শারীরিক শিক্ষা), জসিম উদ্দীন (সাধারণ), রবিউল ইসলাম (আইসিটি), সবুজ কান্তি আচার্য্য (চারু ও কারুকলা)।
প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়া তার ব্যক্তিগত আইডি থেকে তিনটি স্ট্যাটাস লেখেন। একটিতে- তিনি পটিয়া পিটিআই’র চারজন ইন্সট্রাক্টর দ্বারা সংগঠিত বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক কুকর্মের সম্পর্কে অবহিত এবং জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ পিটিআইয়ের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রশিক্ষণার্থীদের এ ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজ ও ধর্ষক চক্রের হাত থেকে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী রক্ষা করতে পারেন বলে উল্লেখ করেন।
অন্যটিতে- তিনি নিজ কন্যাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘তোর দুর্ভাগা প্রতিবাদী বাবা’, ‘আমাকে ক্ষমা করিস মামণি।’
আরেকটিতে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে লেখেন- ‘আমি দেবব্রত বড়ুয়া, পিতা- অমূল্য রতন বড়ুয়া সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ঘোষণা করছি যে, আমার আত্মহত্যার জন্য আমার পরিবারের কোন সদস্য কোনভাবেই দায়ী নয়। আমার আত্মহত্যার কারণে আমার পরিবারের কোন সদস্যকে কোনভাবে পুলিশি বা আর কোনরকম হয়রানি যেন না করা হয়।’

পটিয়া পিটিআইয়ের সুপারিন্টেড (ভারপ্রাপ্ত) তপন কুমার দাশ জানান, ‘সকালে উনার পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়। আমি জানার সাথে সাথে হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে জানতে পারি তিনি আশঙ্কামুক্ত রয়েছেন। আগে কোন সময় প্রশিক্ষণার্থীরা যৌন হয়রানির অভিযোগে আমাকে লিখিত কিংবা মৌখিকভাবে জানাই নি। এমনকি উপজেলা প্রশাসন কিংবা থানা প্রশাসনকেও জানানো হয় নি। তবে কেন কি কারণে এসব অভিযোগ আনা হলো তা তিনি সুস্থ হয়ে আসলে বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া যাবে।’
প্রশিক্ষণার্থী আবু সাইদ জানান, ‘আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক দেখতে গিয়ে স্যারের স্ট্যাটাসগুলো চোখে পড়ে। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি স্যার আত্মহত্যার জন্য ঘুমের ৩০টি ঔষধ খেয়েছেন। তবে তিনি মারা যান নি। যৌন হয়রানি বিষয়টি আমরা এখানে আসার আগের থেকে শুনে আসছিলাম।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নারী প্রশিক্ষকরা জানান, ‘আমরা কোনভাবে মেনে নিতে পারি না। ২০১১ সাল থেকে এ ধরণের যৌন হয়রানির অভিযোগ চলে আসছে। স্যার এসবের প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয় নি। শেষ পর্যন্ত নিজের শরীরকে বিদায় দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। যতদিন স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে না আসে ততদিন আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো না। অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
অভিযুক্ত প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন বলেন, তার সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। তার মানসিক সমস্যা রয়েছে। এর আগেও ২০১৭ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। মূলত তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশে আমি ও আমার সহকর্মীদের নিয়ে এ কাজ করেছেন।
কী কারণে আক্রোশ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমি নিজেও জানি না। এসব অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। তদন্ত সাপেক্ষে আমি দোষী সাব্যস্ত হলে যা শাস্তি হবে তা মাথা পেতে নেবো। তবে আমার মানহানি করায় আমি আমার আইনজীবীর সাথে কথা বলেছি। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা জানান, ‘এখানে দুটো বিষয়- একটি, আত্মহত্যার প্ররোচনা। আরেকটি প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ভিকটিম থানায় মামলা করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। আর প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা লিখিতভাবে পেলে তদন্ত কমিটি করা হবে। ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির কোন সুযোগ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব ঘটনা কোন অবস্থায় কাম্য নয়।
প্রসঙ্গত, পটিয়ায় পিটিআইতে দেড় বছরের কোর্সে প্রতি ব্যাচে ২০০ জন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন। প্রশিক্ষণের পুরো সময় ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
কেএ/এসআর/এসএ