২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ডা. শাহাদাত হোসেনকে সভাপতি ও আবুল হাশেম বক্করকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির কথা কথা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটি মেয়াদ পার করে অতিরিক্ত সময় নিয়েছে আরও এক বছর তিন মাস।
এই সময়ের মধ্যে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম নগর বিএনপির কর্মসূচিতে ছিলেন উপেক্ষিত। অথচ ৭ নভেম্বর বিএনপি ঘোষিত বিপ্লব ও সংহতি দিবসে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির কর্মসূচিতে দেখা গেছে ডা. শাহাদাত হোসেনের নমনীয়তা। শামীমকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে কর্মসূচিও পালন করলেন তারা।
মাহবুবের রহমান শামীমের প্রতি ডা. শাহাদাত হোসেনের হঠাৎ ‘আনুগত্য’ দেখে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে কানাঘুঁষা।
নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন প্রক্রিয়া চলছে এবং সামনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই দুই বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল নিয়েছেন শাহাদাত। আবার কেউ কেউ ভাবছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সর্বশেষ দুই স্কাইপে বৈঠকে শাহাদাত নিজেদের অবস্থান ‘টের’ পেয়ে ‘গোয়ার্তুমি’ থেকে সরে এসে শিষ্টাচার দেখাচ্ছেন। তবে শিষ্টাচার হোক কিংবা নির্বাচন এবং কমিটি গঠনের বৈতরণী পারের কৌশল হোক, দলীয় শৃংখলা ফিরায় নেতাকর্মীরা খুশি।
নেতাকর্মীরা জানান, প্রচুর কর্মসূচি পালন হয়েছে যেগুলোতে সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন আবার প্রধান অতিথিও ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রায় কর্মসূচি চলাকালে এক বা একাদিক কেন্দ্রীয় নেতা চট্টগ্রামে অবস্থান করার পরও নগর বিএনপির কর্মসূচিতে তারা থাকতেন উপেক্ষিত।
তবে এ ক্ষেত্রে আবুল হাশেম বক্কর ছিলেন ব্যাতিক্রম। ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুপস্থিতিতে তিনি যেসব কর্মসূচি আয়োজন করেছিলেন সবগুলোতে শামীমকে প্রধান অতিথি হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। মাঝে মাঝে সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ানকে সভাপতির চেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিজে প্রধান বক্তা থেকেছেন।
আবার শাহাদাত আয়োজিত কর্মসূচিতে অন্য নেতা উপস্থিত থাকলেও ব্যানারে নামের বানান ভুল, অতিথির নামের ফন্ট থেকে ডা. শাহাদাতের নাম বড় অক্ষরে লিখা, বক্তব্য দেওয়ার সাংগঠনিক প্রটোকল এবং দিন শেষে নগর বিএনপির দপ্তর থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নামের সিরিয়ালে উপেক্ষিত থাকতেন অন্য নেতারা। তবে ৭ নভেম্বরের কর্মসূচি শেষে নগর বিএনপির দপ্তর থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এবার প্রধান অতিথি হিসেবে মাহবুবের রহমান শামীমের নাম রয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ৩০ জানুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাবেশে পদাধিকার বলে সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত ছিল মাহবুবের রহমান শামীমের। কিন্তু ডা. শাহাদাত এক প্রকার জোর জবরদস্তি করেই সেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। এ নিয়ে চট্টগ্রাম নগর শাখার বাইরে জেলা শাখাগুলোতে অসন্তোষ ছিল প্রকাশ্যে। কিন্তু শামীমের উদারতায় কোন বিশৃংখলা না হলেও তা দৃষ্টি এড়ায়নি হাইকমান্ডের। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ দেখিয়েছিলেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাও।
তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ঘাম ঝরেছে ডা. শাহাদাত হোসেনের। আবার কারও কারও অভিযোগ টাকাও ঢালতে হয়েছে তাকে মোটা অঙ্কের। এছাড়াও লন্ডন নির্বাসিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে সর্বশেষ দুই স্কাইপে বৈঠকের পর ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ ভাব দূর হয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার হয়েছে ডা. শাহাদাত হোসেনের। সর্বশেষ ১০ অক্টোবর বৈঠকে নগর বিএনপির ৫৫ নেতার সাথে তারেক রহমান ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ কথা বলায় নগর বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা সারাক্ষণ পদ হারানোর আতঙ্কে আছেন বলে জানা গেছে।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নগর বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পরিবর্তে আহ্বায়ক-সদস্য সচিব হিসেবে হলেও টিকে থাকতে লড়াই করছেন। নিজেদের অনুগতদের কয়েকজন নেতাকে দিয়ে প্রচারও করছেন নগর বিএনপিতে তাদের বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে এমন প্রচারণা নিয়ে এক যুগ্ম-সম্পাদকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের নেতৃত্ব তৈরী করার ব্যর্থতায় তারা লজ্জিত না হয়ে আহ্বায়ক-সদস্য সচিব পদ চাওয়াটা যে লজ্জার এটাও তাদের মাথায় আসেনি। নিয়ম অনুযায়ী আহ্বায়ক-সদস্য সচিবের পদ হলো অস্থায়ী। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ হলো পূর্ণাঙ্গ এবং তুলনামূলক বেশী সম্মানের। উনারা সম্মানের পদ ছেড়ে নীচের পদে যেতে চাইছেন। তাদেরকে দিয়ে কী হবে সেটাতো দলের হাইকমান্ড এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এতোদিনে বুঝে গেছেন। তবুও যদি উনারা দলকে পিছিয়ে দেন সেটা তাদের বিষয়।’
নগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ৬ আগস্ট ২০১৬ দলের দায়িত্ব নিয়ে ওয়ার্ড ও থানা বিএনপির কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলেও শতভাগ ব্যর্থতা নিয়েই নিজেদের মেয়াদ শেষ করলেন ডা. শাহাদাত-বক্কর। দল গোছানোর পরিবর্তে দলে বিভক্তি তৈরি করেছেন তারা। ২০১৯ সালের আগস্টে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাক্ষর ক্ষমতা হারান। তখনো তাদের ‘হুশ’ না হওয়া এবং সিনিয়র নেতাদের উপেক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার কারণে ১০ অক্টোবরের স্কাইপে বৈঠকে তারেক রহমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান ও মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের পরামর্শে নগর বিএনপির পরবর্তী কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হবে।
মূলত স্কাইপে বৈঠকের পরই নগর বিএনপির শীর্ষ এই নেতার আচরণে পরিবর্তন আসে বলে জানান দলীয় নেতাকর্মীরা। তারা জানান, ডা. শাহাদাত হোসেন যদি দলীয় শৃংখলা মেনে যার যার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিয়ে এতোদিন দল পরিচালনা করতেন তবে নগর বিএনপির অবস্থান আরও শক্ত হতো। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সাথে নগর বিএনপির দূরত্ব তৈরী হতো না।
এ বিষয়ে কথা বলতে ডা. শাহাদাত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, আবুল হাশেম বক্কর অনুষ্ঠানে থাকায় কথা বলতে চাননি।
জানতে চাইলে নগর বিএনপির যুগ্ন সম্পাদক ইয়াছিন চৌধুরী লিটন বলেন, মাহবুবুর রহমান শামীম, ডা. শাহাদাত হোসেন এবং আবুল হোসেন বকর তিন জনই আমার সিনিয়র। উনাদের বিষয়ে আমি কথা বলা ঠিক হবে না। তবে আমরা সবাই একসাথে কাজ করছি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে।
এফএম/এফএমও