শর্ট লিস্টে ছালাম-সুজন, নাছির এবার ‘আন্ডারডগ’, আড়ালে আরও একজন!

মেয়র মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, উত্তর মিলবে আজ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে কে পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সমর্থন— এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি)। কোনও কারণে ঘোষণা একদিন পিছিয়ে গেলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে আজ— এমনটিই জানিয়েছেন সরকারি দলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা। ভাগ্য নির্ধারণের শেষ দিনের লড়াইয়ে মেয়র নাছিরের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে ক্রমেই। পরিবর্তনের আওয়াজ ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। তবে কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়, কারণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই।

শেষ মুহূর্তের আলোচনায় মেয়র নাছিরকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আরও ৬ জন নেতাকে। শেষ মুহূর্তের লড়াইয়ে থাকা বাকি ৬ নেতা হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী জহুর আহমেদ চৌধুরীর পুত্র ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান, নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু ।

সূত্রগুলো বলছে, চসিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন শেখ হাসিনা নিজেই। শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপে প্রার্থীরা ব্যস্ত। বিভিন্ন কারণে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ হচ্ছে। তবে বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন হাল ছাড়ছেন না। শেষ মুহূর্তে ফলাফল বের করে নেওয়ার বিষয়ে বিশেষ দক্ষতাও আছে তার। তবে শেষ দিনের লড়াইয়ে আ জ ম নাছিরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন সুজন ও ছালাম। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে এই দুই নেতাকে ঘিরে। এই আলোচনায় অনেকটা হঠাৎ করে ঢুকে গেছেন হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান। বাকি দুজনকে নিয়েও আলোচনা হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবে নিশ্চিত করে কেউই কিছু বলতে পারছেন না।

নাছির লড়ছেন পাশার দান উল্টে দিতে
গত নির্বাচনে হেভিওয়েট এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায় করে নেওয়া আ জ ম নাছির এবারও শুরু থেকে আলোচনায় এগিয়ে ছিলেন। তবে পরিবর্তনের সম্ভাবনা যতোই জোরালো হয়েছে, আ জ ম নাছিরের কপালে ভাঁজ বেড়েছে ততোই। এবারই প্রথম আ জ ম নাছিরকে ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে ভাবা হচ্ছে প্রায় সব মহলেই।

এর আগে দীর্ঘদিন দল ও সরকারের কোনও পদ-পদবিতে না থাকা নাছির গত নির্বাচনের আগে অনেকটা চমক হিসেবেই আসেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। অল্প সময়ের মধ্যে পান মেয়রের দায়িত্বও। এক বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে ওঠা আ জ ম নাছির স্থানীয় রাজনীতিতে বিরোধ, জলাবদ্ধতাসহ উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ডে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন। যদিও গত নির্বাচনের আগে তার দেওয়া ৩৬টি অঙ্গীকারের বেশিরভাগই ছিল অধরা। গত ৫ বছরে চট্টগ্রামকে অনেকটা ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে’ পরিণত করার অভিযোগও আছে নাগরিকদের। খেলার মাঠে সুইমিংপুল নির্মাণ, গৃহকর বাড়ানোসহ অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয়দের সমালোচনায় পড়তে হয়েছে। ‘সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের’নামে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ফুটপাত দখল করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ ছিল ব্যাপকভাবে। নগরজুড়ে এ নিয়ে নাগরিকদের সীমাহীন বিরক্তি ও অসন্তোষ। তবে নাছিরের দাবি, প্রতিশ্রুতির ৯০ শতাংশই পূরণ করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘লোভ-লালসা, অনিয়ম-দুর্নীতির উর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আবার সুযোগ পেলে বাকি কাজ শেষ করে মাদক-জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্বমানের নগরী গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তা পূরণে এগিয়ে যাব।’

তবে এটা এখন স্পষ্ট যে, স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বিশাল একটি অংশ নাছিরকে নগরভবনে আর দেখতে চান না। গত রাত পর্যন্ত কেন্দ্র থেকেও সেভাবে আশার বাণী পাননি। এরপরও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শেষ মুহুর্তে ফলাফল ঘরে তোলার আশা এখনও ছাড়েননি নাছির।

না পাওয়ার বঞ্চনা সুজনের, ছালামের ঝুলিতে উন্নয়নযজ্ঞ
দীর্ঘদিনের ত্যাগ, রাজপথের সক্রিয় ভূমিকা ও অতীতে তেমনভাবে মূল্যায়িত না হওয়ার বিষয় পুঁজি করে শেষ দিন পর্যন্ত লড়াইয়ে আছেন খোরশেদ আলম সুজন। এক সময়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখা সুজন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ছিলেন কিংবদন্তী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার। অনেক দিন মূল্যায়িত না হওয়া এই নেতা চাচ্ছেন শেষ বয়সে জনপ্রতিনিধি হয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে। সুজনের সবচেয়ে বড় বঞ্চনা হচ্ছে, তিন তিনবার তাকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দিয়ে আবার ফেরত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েও তাকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম সরকারের শীর্ষ মহলের সুনজরে ছিলেন গত এক দশক ধরেই। চট্টগ্রামের উন্নয়নের সব বিশেষ কর্মযজ্ঞে তার ওপরেই ভরসা রেখেছে সরকার। গত ১০ বছরে তার হাত ধরে নগরে এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। শীর্ষ পর্যায়ের এই সুনজর তাকে রাখছে সুবিধাজনক অবস্থানে। এর বাইরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে বিশাল একটা অংশের সমর্থন সরাসরি ঘরে তুলতে পেরেছেন তিনি।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমাদের দল বিশাল দল, প্রার্থী অনেকেই। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা অনেকেই মনোনয়ন চাইবো, নেত্রী যাকে পছন্দ করবেন তাকে নিয়েই আমরা নির্বাচনী মাঠে আসবো।’

ব্যবসায়ী নেতার তকমা নিয়ে তুফান-বাচ্চু
বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী জহুর আহমেদ চৌধুরীর পরিবারের প্রতি শেখ হাসিনার বিশেষ নজর থাকার কথা সকলেরই জানা। চসিক মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এই পরিবারের সদস্য হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক থাকা এই ব্যবসায়ী নেতার পরিবারের রয়েছে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাঁর বড় ভাই মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিজিএমইএ, এফসিবিসিসিআই ও চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্ব দেয়া এই নেতাকেও মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ। বলছেন শেষ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চমকটি হতে পারেন তিনিই। তবে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তুফানকে বড় জটিলতায় পড়তে হতে পারে বলে কেউ কেউ দাবি করলেও তার পারিবারিক সূত্র এটি নিশ্চিত করতে পারেনি।

অন্যদিকে আ জ ম নাছির উদ্দিনের সাথে মহানগর ছাত্রলীগের একই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু। বর্তমানে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই নেতা কিছুদিন আগেও ছিলেন বাংলাদেশ যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। এসবের বাইরে চিটাগাং কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তিনি। বন্দরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী এই নেতার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায়। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তিনিও। মনোনয়ন পেতে চালিয়ে যাচ্ছেন জোর তদবির। এই লড়াইয়ে এক ঝাঁক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতার সমর্থনও রয়েছে তার প্রতি।

সম্ভাবনায় আছেন রেজাউল
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি রেজাউল করিম চৌধুরী। পরে সেখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোছলেম উদ্দিনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খোরশেদ আলম সুজনের মত তিনিও ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা হিসেবে পরিচিত। সেভাবে মূল্যায়িত হননি তিনিও। এবারের চসিক মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে আছেন এই নেতাও।

এআরটি/এসএ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!