শঙ্খের আহ্বানে দুর্গোৎসব শুরু, বসলো পূজার ঘট
ঢাকের সাজ, সোনালী শাড়ি, বাহারি গহনা, কপালে রক্তজবার সিঁদূর, চোখের সামনে ভেসে ওঠে একচালা চালচিত্রের প্রতিমা, টানা টানা চোখ, সে চোখে লেগে থাকা সূদূর হিমালয় থেকে বাপের বাড়ি আসার আনন্দ। প্রতিমার রূপে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী দুর্গা সুসজ্জিত হয়ে প্রস্তুত। দেবী দুর্গাকে প্রণাম করতে ভক্তদের পদচারণায় মুখর মন্দির প্রাঙ্গণ। জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে কৈলাস থেকে নেমে এসেছেন মর্ত্যলোকে। শরতের অকাল বোধনের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠীর দিনের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ঢাকঢোল ও শঙ্খধ্বনিতে মেতে উঠেছে বাঙালীর সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সকালে অল্পারম্ভ, বিহিত পূজা ও বোধনের ষষ্ঠী পূজার ঘট বসেছে চট্টেশ্বরী মন্দিরে।
চট্টেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘মা দুর্গা কৈলাস থেকে পৃথিবীতে এসেছেন। আমরা তাকে বরণ করে নিয়েছি, শুরু হয়েছে দুর্গা উৎসব। দুর্গা পূজার মাধ্যমে দেশের সকল মানুষের মঙ্গল কামনা করছি।’
মন্দিরে শুক্রবার ভোরে শুরু হয় ষষ্ঠীপূজার আয়োজন। ঢাক-ঢোলের বাজনা, কাঁসা, শঙ্খের আওয়াজ এবং ভক্তদের উলুধ্বনিতে দেবী দুর্গাকে পৃথিবীতে স্বাগত জানান ভক্তরা।
হিন্দু পুরাণ মতে, আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষে বাসন্তী দুর্গা পূজার সময় গণনা করা হতো। আগেকার সময়ে বসন্তকালে জলবসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিলে রোগ-শোক, অভাব দেখা দিত। সনাতন ধর্ম মতে, যা কিছু দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। ফলে তখন থেকেই বাসন্তী পুজো অপেক্ষা শরৎকালের দুর্গোৎসব কালক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সেই থেকে অকাল বোধন হওয়া সত্বেও শরৎকালেই দুর্গা পূজা প্রচলন হয়ে যায়।
চিরাচরিত নিয়মানুসারে চট্টেশ্বরী মন্দিরে অষ্টমীর ভোগে চাল বা তা থেকে উৎপন্ন সামগ্রী ব্রাত্যই রাখা হয়। ভোগে নিবেদন করা হয় লুচি, আলু ফুলকপির তরকারি, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, মিষ্টি এবং ফল। পাশাপাশি সপ্তমী থেকেই চলে নৈবেদ্যর ডালা। একবছর পর পর আসা ‘মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণী’র সমাদরে আয়োজনের বিন্দুমাত্র কমতি রাখেন না চট্টেশ্বরী মন্দিরের সেবায়েতরা।
সেবায়েত বাড়ির সদস্য চন্দ্রা চক্রবর্তীর কথায়, ‘পূজোর সবকটা দিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়। দেবী মায়ের কাছে চাওয়া ‘জগতের সকল প্রাণি যেন সুখে শান্তিতে থাকতে পারে।
পূজার সবকটা দিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সে আয়োজনও বিশাল। সপ্তমীতে ২৩, অষ্টমীতে ৩২, আবার নবমীতে ২৭, এরকম কম বেশি সংখ্যায় মাকে নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। সকাল থেকে ভোররাত অবধি চলে এই পর্ব। চট্টেশ্বরী মন্দিরের নৈবেদ্য রাঁধুনি বিধান চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পঞ্চমীর দিন থেকে পূজার দিনক্ষণ শুরু হয়। ষষ্ঠীতে মূল আনুষ্ঠানিকতা। পাঁচদিনব্যাপী পূজায় সবজি পোলাওসহ দুর্গোৎসবের সকল নৈবেদ্য রান্না করে পূজার্থীদের প্রসাদ দেয়া হয়।’
এরপরে সপ্তমীতে কলাবউ স্নান, অষ্টমীতে একসঙ্গে ‘নারায়ণী নমস্তুতে’ মন্ত্রে অঞ্জলি, পরবর্তীতে সন্ধিপুজো, ১০৮টি প্রদীপে সন্ধিক্ষণকে ধরে রাখার মতো উপাচারে যেন একচালাতেই চলে চট্টেশ্বরী মন্দিরে।
শনিবার হবে মহাসপ্তমী পূজা। এরপর রোববার মহাঅষ্টমী ও কুমারী পূজা। সোমবার মহানবমী আর মঙ্গলবার বিজয়া দশমী। দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে ঘোড়ায় চড়ে বিদায় নেবেন দেবী দুর্গা।
ষষ্ঠীর সকালে চট্টেশ্বরী মন্দিরে পূজা দেখতে আসেন মৌসুমী মৌ। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা। ষষ্ঠী পূজার সকালে মন্দিরে ঠাকুর দেখতে না এলে পূজার আনন্দ অনুভব করা যায় না। মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখে আসি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,‘দুর্গাপূজা নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। ভক্তরা মন্দিরে মন্দিরে যেতে শুরু করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’
নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আমেনা বেগম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সকল থানার অফিসারদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক টিমও রয়েছে তারা সেখানে পাহারা দিবে। নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের মোবাইল টিম সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছে। এছাড়া যেকোনো প্রয়োজনে পুলিশের কল সেন্টার ৯৯৯-এ ফোন করলে তাৎক্ষণিক আইনি সহায়তা পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও জানান, ‘দুর্গাপূজা উপলক্ষে যে কোনও প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের নম্বর ০৩১-৬১১৫৮১ ও ০১৮৮০-০০২৪২৪-এ যোগাযোগ করা যাবে। এবং প্রতিমা বিসর্জনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
চট্টগ্রাম নগরীতে এবার ২৭২টি মণ্ডপে এবং উপজেলায় ১ হাজার ৮৩২টি পূজা মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। মহানগর ও উপজেলায় এবার সার্বজনীন ও পারিবারিক পূজা মণ্ডপসহ মোট ২ হাজার ১০৪টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। ৫ অক্টোবর শনিবার সকালে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের পর শুরু হবে মহাসপ্তমী পূজা। ৬ অক্টোবর রোববার মহা অষ্টমীর পূজা, সে দিন হবে সন্ধি পূজা। সোমবার (৭ অক্টোবর) সকাল বিহিত পূজার মাধ্যমে হবে মহানবমী পূজা এবং ৮ অক্টোবর মঙ্গলবার বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বির্সজনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনের দুর্গা পূজা। পাঁচ দিনব্যাপী মণ্ডপে মণ্ডপে চলবে পূজা-অর্চনা, ভক্তিমূলক সঙ্গীতানুষ্ঠান, মহাপ্রসাদ বিতরণ, সন্ধ্যায় আরতি।
এসআর/এসএস