লুটের মাল চট্টগ্রাম নগরীর ‘অক্সিজেন’ আগ্রাবাদ ডেবা
বন্দর-রেলের টানাটানিতে মজা লুটছে ইজারাদার
দিঘী কিংবা জলাশয়গুলো নগরের হৃৎপিণ্ড। এগুলো অনেকটা নগরের বাসিন্দাদের শরীরে ‘অক্সিজেন’ হিসেবে কাজ করে। চট্টগ্রাম নগরীর বুকে এমনই এক অক্সিজেনের আধার ‘আগ্রাবাদ ডেবা’ এখন দখলে-দূষণে মরণাপন্ন। ইজারা নেওয়া লোকের হাতে পড়ে ডেবাটি ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। ডেবার অনেক মূল্যবান জায়গা ইতিমধ্যে চলে গেছে বেদখলে। সবমিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে লুটপাটের স্বর্গভূমি।
ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বন্দর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের সময় প্রয়োজন হয় লাখ লাখ টন মাটি। তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে এই মাটি সংগ্রহের জন্য আগ্রাবাদের জায়গাটি থেকে মাটি তোলে। তাতে তৈরি হয় বিশাল এক জলাশয়। পরে ‘আগ্রাবাদ ডেবা’ হিসেবে পরিচিতি পায় এটা। দীর্ঘ সময় ধরে এই জলাশয় থেকে পানি সরবরাহ করা হতো জাহাজ, রেলইঞ্জিনসহ আবাসিক এলাকায়।
সম্প্রতি আগ্রাবাদ ডেবা ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ২৭.৪ একর আয়তনের বৃহৎ এই জলাশয়ের পাড়সহ একটি বড় অংশ দখল হয়ে গেছে। পাড় ছাড়া এর জলাধার রয়েছে প্রায় ২০ একর। এর মধ্যে ১৬ একর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিএস খতিয়ানভুক্ত।
২০ একর আয়তনের এই জলাধার ইজারা নিয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী। তিনি মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী-সন্তানরা দীঘিটির উল্লেখযোগ্য অংশ ভরাট করে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিচ্ছেন। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দনের নেতৃত্বে একটি টিম আগ্রাবাদ ডেবা এলাকায় অভিযান চালায়। ওই অভিযানে জলাশয়টি দখল হওয়ার প্রমাণ পায় দুদক। তবে শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এদিকে রেলের সঙ্গে এই ইজারাদারদের মামলা থাকায় বিশাল এ দীঘি থেকে রাজস্বও পাচ্ছে না রেলওয়ে। কয়েক যুগ ধরেই চলছে এ মামলা। এ কারণে একাধিকবার দরপত্র ডেকেও এটি ইজারা দিতে পারেনি রেলওয়ে।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, বিশাল এই জলাশয়টি অবহেলায় অযত্নে একদিকে দখলবাজি আর অন্যদিকে দূষণের হুমকিতে পড়েছে। রেলওয়ে মৎস্য চাষের নামে এটি নিয়মিত ইজারা দিয়ে আসছে। অথচ এই বিশাল দৃষ্টিনন্দন জলাশয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঠিক রেখে পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে একে বেড়ানোর নির্মল জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা যেত। যার পাড়ে সবুজ উদ্যান আর নিরিবিলি হাঁটার পথ তৈরি করা গেলে জলাশয়টির চেহারাই পাল্টে যেতো।
জানা গেছে, একসময় রেল ও বন্দর অভিন্ন সংস্থা ছিল। ১৯৬০ সালে এই দুটি সংস্থা পৃথক হওয়ার সময় চট্টগ্রাম প্রাণকেন্দ্রে ‘আগ্রাবাদ ডেবা’র পশ্চিমপাড়সহ জলাশয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ের জায়গা রেলওয়ে ভোগ করবে— এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০ একর জায়গার জলাশয় ১৬ একর কাগজপত্রে বন্দরের হলেও দীর্ঘদিন ধরে সেটি দখলে রেখেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। শুরু থেকে তারাই সেটি ইজারা দিয়ে আসছে।
জানা গেছে, রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বসবাসের জন্য এ ডেবার পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বেশ কিছু স্থাপনা। বর্তমানে সেগুলোও এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। সন্ধ্যা নামলেই ডেবার পাড়ে বসে ফেনসিডিলসহ মাদকের আসর।
সূত্র জানায়, আগ্রাবাদ ডেবা বা দিঘীর মালিকানা মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের। কিন্তু ৬০ বছর ধরে ওই ডেবা আছে রেলওয়ের দখলে। রেলের ভোগেও সেভাবে নেই, ইজারা নিয়ে পুরো ডেবাটিই অন্য লোকের দখলে থাকছে যুগের পর যুগ। আগ্রাবাদ ডেবার দখল ছাড়ার জন্য রেলওয়েকে দফায় দফায় চিঠি দিলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ইজারাদারের দখলে থাকা জলাশয় নিয়ে মামলা থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে সেটি তারা হস্তান্তর করতে পারছে না। ওদিকে সেই মামলা চলছে কয়েক যুগ ধরে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (ভুমি) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি আগ্রাবাদ ডেবা ইজারা না দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছি রেলওয়েকে। দীর্ঘদিন ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষের ১৬ একর ভূমি দখলে রেখেছে রেল। এই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমরা বারবার তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু রেল তাতে কান দিচ্ছে না।’
অন্যদিকে রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবউল করীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায় ২০ একরের ডেবাটি দীর্ঘদিন ধরেই ইজারা দিয়ে আসছে রেলওয়ে। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ৫ বছর মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর মেয়াদ শেষ হলেও ইজারাদার আবারও তার কাছে ইজারা রাখার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। এ পিটিশন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ইজারা দিতে পারছি না।’
আগ্রাবাদ ডেবায় বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জলাশয়ের মালিকানা বন্দর কর্তৃপক্ষের থাকলেও এটি দীর্ঘকাল থেকে রেলওয়ের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। একসময় তো দুটি সংস্থাই এক ছিল।’
তবে আগ্রাবাদ ডেবার রিট মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে ইজারাদারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এএস/সিপি