লন্ডনে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। এর ২০ দিন আগে লন্ডনে তাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ছেলেসহ ঈদের জামাতে।
এবার সেই লন্ডনেই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সমালোচিত নেতাদের অন্যতম হাছান মাহমুদকে দেখা গেল বিয়ের অনুষ্ঠানে। তিনিই শুধু নন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলে ডা. সৈয়দ ফাইয়াজ রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাবেক আরও অন্তত তিনজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দেখা মিলেছে।
স্থানীয় সময় রোববার (২০ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সেই বিয়েতে অংশ নেন সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। সিলেটের সাবেক সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবকেও বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখা গেছে।
এর আগে গত ১৩ এপ্রিল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলের মেহেদি অনুষ্ঠান। সেখানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে দেখা গেলেও আমন্ত্রিত হয়েও হাছান মাহমুদ সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।

ঈদ করতে লন্ডনে
এর আগে গত ৩০ মার্চ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে দেখা গেছে, লন্ডনের গ্যাংসহিল এলাকার আল-কালাম মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে।ঈদের নামাজ শেষে পরিচিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন লন্ডনে পড়াশোনা করা তার ছেলে সাফওয়ান মাহমুদ। বর্তমানে বেলজিয়ামে বসবাসরত হাছান মাহমুদ ছেলের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে লন্ডনে যান।
এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন হাছান মাহমুদ।
বিধ্বস্ত চেহারা, স্বর অনুচ্চ
গত ২১ ফেব্রুয়ারি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউনিভার্সিটি লিবর ডি ব্রাসেলসের (ইউএলবি) বাইরের একটি উঠানে শহীদ মিনারের একটি কাঠামো সঙ্গে করে নিয়ে এসে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের পলাতক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের চার নেতা ও তাদের স্ত্রীরা। একুশের শোকাবহ দিনে উপস্থিত মোট সাত অংশগ্রহণকারীকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেলেও হাছান মাহমুদ ছিলেন বিধ্বস্ত চেহারায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে এক ভিডিওতে তার গলার স্বরও ছিল অনুচ্চ। সেখানে তারা ‘একুশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক হও লড়াই করো’সহ কয়েকটি শ্লোগান দিয়ে মোবাইলে ভিডিও তুলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তড়িঘড়ি গাড়িতে ওঠে অন্যত্র চলে যান।
বেলজিয়ামে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন— এমন এক বাংলাদেশি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে হাছান মাহমুদ তো দূরের কথা, এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও পাবলিক কোনো প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করতে দেখা যায়নি। এখনও তারা অনেকটা আড়ালেই থাকেন। সাধারণ প্রবাসীদের ব্যাপক ক্ষোভ আছে তাদের ওপর।’
ওই প্রবাসী বলেন, ‘ব্রাসেলস থেকে হাছান মাহমুদের বাড়ি প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে। তিনি সেখানেই থাকেন। বেলজিয়ামে তার আরও অন্তত চারটি বাড়ি আছে বলে শুনেছি। প্রবাসীদের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে তাকে এখন পর্যন্ত পাবলিক কোনো প্লেসে সেভাবে দেখা যায়নি।’
জার্মানিতেও তোপের মুখে
এর আগে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে আওয়ামী লীগের সভায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েন হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানস্থলে তিনি উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তিনি নীরবে সভাস্থল ছেড়ে যান।
ওই সময় বার্লিন থেকে যাওয়া এক আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনাদের লোভ আর দুর্নীতির কারণেই দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা আজকে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে সবার জীবন। আহত নিহত নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর আপনি রাখেন নাই। যাকে ইচ্ছা তাকে দলে ঢুকিয়েছেন। আপনাদের দুর্নীতির কারণে দল আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা।’
ঢাকা থেকে জার্মানি পালান ২৫ আগস্ট
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, গত বছরের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছান। সেই থেকে বেলজিয়ামে তিনি লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন।
এর আগে ৪ আগস্ট রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ থেকে পালিয়ে যান। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নেই থাকেন।
হাছান মাহমুদ দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ভাগ্য খুলে যায় হাছান মাহমুদের। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।
সিপি