রেল উন্নয়নে চার ছাত্রের কীর্তি, টিকিট কালোবাজারি-চাঁদাবাজির অডিও ভাইরাল

একই সময়ে দুই ট্রেন ভ্রমণ!

সরকারি সিদ্ধান্তে রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল কিছু অভিজ্ঞতাহীন ছাত্রের হাতে—কেবল একজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ইচ্ছায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে চার শিক্ষার্থী পেয়েছিলেন রেল ভবনে অবাধ প্রবেশাধিকার, ভ্রমণের ফ্রি পাস, এমনকি লোকোমোটিভ ডিজাইনের মত স্পর্শকাতর দায়িত্বও। এমনকি রেলের দখল হওয়া জায়গা পুনরুদ্ধার ও কালোবাজারি বন্ধসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে তাদের কার্যক্রমের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশও করা হয়। অথচ এই চারজনের বিরুদ্ধে এখন উঠছে টিকিট কালোবাজারি, ঘুষ লেনদেন ও প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ। রেল নিরাপত্তা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।

জানা গেছে, রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের ইচ্ছায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার কর্মীর হাতে ‘রেলকে একটি লাভজনক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা’র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কারও মতামত না নিয়েই ন্যূনতম অভিজ্ঞতাহীন এই ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল রেলের ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভের সক্ষমতা, ডিজাইন, ত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত দায়িত্বও।

এরা হলেন— জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাস্টার্স) শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বাপ্পী এবং রাজউক কলেজের ছাত্র নাজিব আহমেদ।

সূত্র জানায়, এই চারজনের রেল ভবনে ছিল অবাধ যাতায়াত। উর্ধতন কর্মকর্তারাও তাদের ভয় পেতেন। মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য দুই মাসের জন্য দেওয়া হয়েছিল ফ্রি পাস, যার মাধ্যমে তারা দেশের যেকোনো প্রান্তে এসি বার্থ ও স্নিগ্ধায় ভ্রমণ করতে পারতেন—তাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

তবে খতিয়ে দেখা গেছে, এই ফ্রি পাস ব্যবহার করে তারা শুধু ভ্রমণই করেননি, বরং একই দিনে, একই নামে একাধিক গন্তব্যে যাতায়াতের টিকিট কেটে টিকিট কালোবাজারিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন একই তারিখে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এবং সেই তারিখেই রাজশাহী থেকে ঢাকা ভ্রমণের টিকিট সংগ্রহ করেছেন—যা বাস্তবিকভাবে অসম্ভব।

সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছেন, নিয়মিত এভাবে টিকিট সংগ্রহ করে তা অবৈধভাবে বিক্রি করে দিয়েছেন এই ছাত্রপ্রতিনিধিরা। শুধু দুই মাস নয়, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টাকা মূল্যের টিকিটের অপব্যবহার হয়েছে এই চারজনের হাতে। তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নাজিব আহমেদের সম্পৃক্ততা কম হলেও সম্পূর্ণ মুক্ত নয়।

সম্প্রতি লেখা এমন এক চিঠিতে বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিম্নোক্ত ০৩ (তিন) সক্রিয় কর্মী বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটি লাভজনক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। তাদের এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশ রেলওয়ের অবৈধভাবে দখলকৃত জমি উদ্ধার, টিকিটের কালোবাজারি বন্ধ এবং অভ্যন্তরীণ কাজে সহযোগিতা করছেন বিধায় তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। যেহেতু তাদের কার্যক্রম এখনও সম্পন্ন হয়নি তাই ট্রেন পাসের মেয়াদ বৃদ্ধির বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।’

এদিকে এই চারজন জুলাই ফাউন্ডেশন-এর ব্যানারে বড় বড় স্টেশনে দোকান বরাদ্দ ও প্রাইভেট ট্রেন পরিচালনার আবেদনও করেছেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি অডিও রেকর্ডিং—যেখানে রেলের বদলির বিনিময়ে অর্থ লেনদেনের আলোচনা উঠে এসেছে—তাদের জড়িয়ে আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

অডিও ফাঁস: ছাত্র প্রতিনিধি নাকি চাঁদাবাজ?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে ‘রেল উন্নয়নে’র দায়িত্ব পাওয়া দুই ছাত্র প্রতিনিধির বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) ঢাকার কমান্ড্যান্টের সঙ্গে টাকার লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়ে পড়েছে।

অভিযুক্ত দুই ছাত্রপ্রতিনিধি হলেন—জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম ও ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বাপ্পী।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া অডিও রেকর্ডে শোনা গেছে, মেহেদী কথা বলছেন আরএনবি ঢাকার কমান্ড্যান্ট মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় মেহেদী বলছেন, ‘ওই যে, ওটার কি অবস্থা?’ তখন শফিকুল বলছেন, ‘আমি তো ওইদিন আপনার সামনেই বললাম, কোর্টের মধ্য থেকে যে টাকাটা জমা সেটা তোলার জন্য। আপনার সামনেতো আমে কলও বাজায়া শোনাইলাম, ঠিক আছে? যে ওইটা না হলে তো আমি আপনারে দুই লাখ টাকাও দিতে পারবো না। আমার কাছে অত টাকা নাই রে ভাই। আর পাশপাশি হচ্ছে, আমার কোনো ইনকাম সোর্সও নাই।’ এরপর মেহেদী বলছেন, ‘আপনাদের লাইন বের করা হবে। ওটা কোনো ব্যাপার না। টানাটুনা করা যাবে। কিন্তু এদিকে যারা ক্ষমতাশালী তারা তো মনে করেন যে, যারা টাকা-পয়সা কামাইছে, বুঝেন না, প্রেসার তো আপনি পাবেন।’

কমান্ড্যান্ট শফিকুল বলেন, ‘আমি তো বলছি, শহীদুল্লাহ শহীদ যখন বলছে যে, ইয়ে করার জন্য, তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে নিয়েন। এই গাদ্দারের সাথে গাদ্দারি করতে তো কোনো সমস্যা নাই। ১০ লাখ টাকা নিয়া নিয়েন, করলে করবেন কাজ, না করলে নাই। সে গেছে মাত্র কয়েকদিন আগে। সে যদি এখন মনে করে যে, তার আবার ফিরতেই হবে…।’

এর মধ্যে মেহেদী বলে ওঠেন, না ভাই, সমস্যা নাই। আপনার সাথে যে কথা হয়েছে, আপনি ওটাই করেন। তাহলে ওটা হচ্ছে কবে, কালকে? নাকি?’ কমান্ড্যান্ট শফিকুল বলেন, কোর্ট থেকে টাকা উঠলে সাথে সাথেই আমি দিয়া দিবো, প্রমিজ। ঠিক আছে? কিন্তু আমার কষ্ট হইতাছে এই কারণে যে, এর বাইরে তো আমার কাছে কোনো টাকা নাই। আপনারা বলছেন…।’

এরপর মেহেদী তার পাশে থাকা রেজাউলকে ডেকে নিয়ে কমান্ড্যান্টের সঙ্গে কথা বলতে ফোনে ধরিয়ে দেন। রেজাউলকে মেহেদী বলেন, ‘শফিক ভাই, কথা বলেন।’ অপরপ্রান্তে থাকা কমান্ড্যান্ট বলেন, ‘রেজাউল ভাই…।’ রেজাউল ‘কি অবস্থা?’ জানতে চাইলে কমান্ড্যান্ট শফিকুল বলেন, কালকে তো আপনার ওই যে, রেস্ট হাউসে গেলাম। গিয়ে তো একেবারে কল রেকর্ড বাজায়ইয়া শোনালাম না? আমি বললাম যে, আমি কি কালকে আসবো? পরে তো দেখলেন যে, কোর্টের যে বেঞ্চ সহকারী বললো যে, ও তো লেখা জানতো না, আমি লিখা তারপর ওটা অ্যাকাউন্টসে পাঠাইছি। আমি জানাইমু, আমি জানাইলে আপনি আসবেন। আজকে এখনও পর্যন্ত জানাই নাই কোর্টে যাওয়ার জন্য। এখন যদি, কালকে যদি বলে অবশ্যই কালকে আমি যামু, প্রেসার ক্রিয়েট করমু, আমারও তো টাকাটা দরকার। ওই জায়গা থেকে কিছু টাকা পাইলে, বাকি টাকা দিয়ে আমি ইয়ে করবো।’

কমান্ড্যান্ট শফিকুলের একথা শেষ করার আগেই রেজাউল বলেন, ‘এখন ভাই আপনি ওটা দেখেন, আমার কাছে কিছু বইলেন না ভাই। আপনি কি করবেন সেটা আপনার বিষয়। আপনি বললেন, যেদিন বলছেন, সেটাই তো আপনার ইয়ে করা হয়েছে, তাই না।’ তখন কমান্ড্যান্ট শফিকুল বলেন, ‘ভাই শোনেন, ঠিক আছে। আমি তো অস্বীকৃতি জানাইতেছি না। আপনারা চাইছেন, আমি অস্বীকৃতি জানাইতেছি না। বাট আমার তো…।’ কথা শেষ না হতেই রেজাউল বলেন, ‘কালকে আপনি দেখা করেন ভাই, কালকে আপনি দেখা করেন। অথবা আজকে দেখা করেন।’ তখন কমান্ড্যান্ট শফিকুল বলেন, ‘ঠিক আছে রেজাউল ভাই, ঠিক আছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm