রেলে দুর্নীতিতে ভরা আজব নিয়োগ, ৫ কর্তা টাকায় লাল!

চট্টগ্রাম রেলওয়ের নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ ইউসুফ রায়হানকে ঢাকা বিভাগ থেকে খালাসি পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও, জামালপুর থেকে তাকেই আবার একই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। রাজশাহী ট্রাফিকের গেইটকিপার আরিফ হোসেন ঠাকুরগাঁও জেলা কোটায় খালাসি পদে নিয়োগ পান। এর পাশাপাশি তিনি আবার ওয়েম্যান পদেও চাকরি পান ওই একই জেলার কোটায়। অন্যদিকে তার বোন আয়েশা সিদ্দিকা রাত্রিরও চাকরি হয়েছে খালাসি পদে।

এভাবে পুরো নিয়োগই হয়েছে অনিয়ম ও খামখেয়ালির ওপর ভর করে। নানামুখী তদবির হয়েছে ব্যাপক। আর্থিক লেনদেন হয়েছে অভাবনীয় হারে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৮৬৩ খালাসি নিয়োগে ঘটেছে এমন কাণ্ড। এতে নিয়োগ পেয়েছেন একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি। আবার একই ব্যক্তির নিয়োগ হয়েছে দুই পদেও। নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকে বয়স ও সার্টিফিকেট জালিয়াতিরও আশ্রয় নিয়েছেন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম, তদবির ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ৮৬৩ জনকে খালাসি পদে নিয়োগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মানা হয়নি কোনও নিয়ম-নীতি। রেলওয়ের গঠিত নিয়োগ কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজনের স্বাক্ষর ছিল ওই নিয়োগে। এমন জালিয়াতির ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে ফেঁসে যাচ্ছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও কমিটির সব সদস্যসহ সেখানকার একাধিক ঠিকাদার।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ৮৬৫ জন খালাসি পদে নিয়োগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। ওই সময় সংগঠনের নেতারা অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপও কামনা করেন। এ ঘটনার পর দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় থেকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

দুদক সূত্রে জানা যায়, পূর্বাঞ্চলে ৮৬৩ জন খালাসি পদে নিয়োগের অধিকাংশ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে মোটা অংকের অর্থ ও তদবিরের মাধ্যমে। এতে মানা হয়নি পোষ্য কোটা। হদিস পাওয়া যায়নি নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও রেকর্ডপত্রেরও।

দুদক সূত্রে জানা যায়, জালিয়াতিতে ভরা এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন এমনকি একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিও। আবার একই ব্যক্তির নিয়োগ হয়েছে দুই পদে। নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকে পাহাড়ি কোটায় বয়স ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ কমিটির ৫ জনের মধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর পাওয়া গেছে মাত্র দুজনের। বাকি তিন জনের স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ কমিটির ৫ সদস্য আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে বলে অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়।

অভিযুক্তরা হলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমেদ, গঠিত নিয়োগ কমিটির পাঁচ সদস্য, পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও একাধিক রেলওয়ের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার।

বিধি মোতাবেক ১৯৮৫ সালের নিয়োগ আইন অনুসারে সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয় মহাব্যবস্থাপককে (জিএম)।

দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন ও রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৮৬৩ জনের বেশিরভাগই নিয়োগ পেয়েছেন। এ ঘটনায় অনুসন্ধানে গিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত আংশিক রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ৮৬৩ খালাসি পদে অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় শীঘ্রই প্রধান কার্যালয় বরাবরে তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ৮৬৩ জন খালাসি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যাচাই-বাছাই শেষ করতে লেগে যায় প্রায় দুই বছর। কর্তৃপক্ষের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে নানা জটিলতায় পিছিয়ে যায় আরও ৬ বছর। এর মধ্যে কমিটির এক সদস্য মারাও যান। ২০১৫ সালে আবেদনকারীদের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০১৮ সালে শেষের দিকে ৮৬৩ জনকে খালাসি পদে নিয়োগ দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!