রেড নোটিশে চট্টগ্রামের দুই সাবেক মন্ত্রী, টপ টার্গেটে শেখ হাসিনা ও বেনজীর

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন এবং বাকস্বাধীনতা দমনসহ একাধিক অভিযোগে ক্ষমতাচ্যূত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রভাবশালী কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রামের দুই বিতর্কিত সাবেক মন্ত্রী—সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

এই দুই সাবেক মন্ত্রীর একজন—হাছান মাহমুদ বর্তমানে বেলজিয়ামে এবং অন্যজন—মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভারতে পালিয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। শেখ হাসিনাও ভারতেই অবস্থান করছেন। তাদের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে বলে সম্প্রতি জানা গেছে।

রেড নোটিশের আবেদনের পেছনের কারণ

সূত্র জানায়, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানিসহ একাধিক দেশে থাকা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের একটি জোট সম্প্রতি ইন্টারপোল ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক নিপীড়ন, গুম, মিডিয়া দমন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়, বরং যারা সরাসরি এসব কার্যক্রমের নীতিনির্ধারক বা মুখপাত্র ছিলেন—তাদেরকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে হাছান মাহমুদ ও নওফেলকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

তালিকায় আরও যারা

রেড নোটিশের আবেদনে আরও যেসব প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার নাম রয়েছে, তারা হলেন— আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে প্রথম রেড নোটিশ চেয়ে আবেদন করা হয়। ঢাকার একটি আদালতের নির্দেশে দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

অন্যদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। একই মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি।

হাছানের দুর্নীতির পাহাড়, বিদেশে সম্পদ

হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় ২০ দিন পর নিরাপদে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। গত বছরের ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে পরে বেলজিয়ামে যান। এর আগে গত বছরের ৪ আগস্ট রাতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ ছাড়েন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকেন। তার একমাত্র ছেলে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করছে।

এর আগেও তিনি দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন হাছান মাহমুদ। সেখানে তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবেই থাকেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯২ সালের দিকে প্রথম বেলজিয়াম যান হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি বেলজিয়ামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ও লিম্বুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও করেছেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়।

পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।

সবশেষ গত ৬ এপ্রিল জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm