রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমানের নিদর্শন ও উম্মতের অন্যতম দায়িত্ব

আমরা এমন এক নবীর উম্মত, যিনি সমগ্র মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। তিনি হলেন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল, মানবজাতির পথপ্রদর্শক এবং বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তাঁর আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছাড়া কোনো মুসলমানের ঈমান পূর্ণ হয় না। নবিজি (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমগ্র মানবজাতির চেয়েও প্রিয় না হই।’ (বুখারি ও মুসলিম)

এই হাদিস আমাদের সামনে এক চিরন্তন সত্য তুলে ধরে—রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা কোনো ঐচ্ছিক অনুভূতি নয়, বরং ঈমানের অপরিহার্য অংশ। একজন প্রকৃত মুমিনের হৃদয়ে নবিজির প্রতি এমন ভালোবাসা থাকতে হবে, যা সব পার্থিব সম্পর্ক ও ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যায়।

নবিজির প্রতি ভালোবাসা: ঈমানের প্রাণ

ভালোবাসা একটি স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতি। কিন্তু নবিজির প্রতি ভালোবাসা কেবল হৃদয়ের অনুভূতি নয়, এটি এক বিশেষ ঈমানি সম্পর্ক। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি, তাঁর প্রতিটি বাক্য, কাজ ও অনুমোদন আল্লাহর নির্দেশেরই প্রতিফলন। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনি (মুহাম্মদ) নিজ থেকে কিছু বলেন না। এটি ওহি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা নজম : ৩–৪)

অতএব, নবিজির প্রতি ভালোবাসা মানে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা, তাঁর আদর্শে জীবন গঠন করা, তাঁর শিখানো নিয়মে চলা এবং তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অনুগত থাকা।

নবিজির প্রতি উম্মতের প্রধান দায়িত্বসমূহ

এক. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর পূর্ণ ঈমান আনা
নবিজি (সা.) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল। তাঁর আনীত বার্তায়, শিক্ষা ও কর্মে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা রাখা ঈমানের পরিপন্থী। নবিজির ওপর পূর্ণ বিশ্বাস মানে তাঁর কথার সত্যতা স্বীকার করা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধকে আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করা।

দুই. নবিজির সুন্নাহ অনুসরণ করা
সুন্নাহ অনুসরণ ঈমানের অঙ্গ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে নবী, আপনি বলুন— যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)
নবিজির জীবনধারা ছিল কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা। তাঁর প্রতিটি আচরণ, দয়া, নম্রতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিকতা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। তাঁর সুন্নাহ অবলম্বন মানে সেই পথেই চলা, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়।

তিন. রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা
এই ভালোবাসা হতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের—নিজের জীবন, পরিবার, সম্পদ ও সম্মানের চেয়েও ঊর্ধ্বে। নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা ও সন্তানদের চেয়েও প্রিয় না হই।’ (বুখারি)
ভালোবাসা কেবল মুখের কথা নয়; তা প্রমাণ করতে হয় আনুগত্যের মাধ্যমে। নবিজির আদর্শ অনুসারে চলাই সেই ভালোবাসার প্রকৃত প্রকাশ।

চার. নবিজির ওপর দরুদ পাঠ করা
দরুদ পাঠ নবিজির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ। আল্লাহ নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবির ওপর দরুদ পাঠ করেন। হে মুমিনগণ, তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পাঠ করো।’ (সুরা আহযাব : ৫৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওপর দশটি রহমত বর্ষণ করবেন, দশটি গুনাহ মাফ করবেন এবং মর্যাদা দশগুণ বৃদ্ধি করবেন।’ (নাসাঈ)
দরুদ পাঠ শুধু নেকি অর্জনের উপায় নয়, এটি নবিজির শাফায়াত লাভেরও মাধ্যম।

নবিজির প্রতি ভালোবাসার প্রকৃত রূপ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা মানে তাঁর আদর্শে নিজেকে গঠন করা। কেবল মুখে ভালোবাসার দাবি করা যথেষ্ট নয়, বরং সেই ভালোবাসা প্রকাশ পাবে আমাদের জীবনে—আমাদের আচরণ, পোশাক, নৈতিকতা, কর্ম, ও আমলে।

নবিজির প্রতি ভালোবাসার অংশ হলো তাঁর সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, স্ত্রীগণ ও সন্তানদের ভালোবাসা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি বিষয় রেখে যাচ্ছি—একটি আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও অন্যটি আমার আহলে বাইত। তোমরা যদি এদের আঁকড়ে ধরো, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’ (তিরমিজি)

নবিজির দয়া, করুণা ও মানবপ্রেম

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মানবতার ইতিহাসে সর্বাধিক দয়ালু ও মমতাময় ব্যক্তি। কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর চরিত্র এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এমন এক রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের কষ্টকে কষ্ট মনে করেন, তোমাদের কল্যাণ কামনা করেন এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়।’ (সুরা তওবা : ১২৮)

তিনি নিজের স্বস্তির চেয়ে উম্মতের মুক্তির জন্য বেশি ব্যাকুল ছিলেন। তাঁর রাত্রিগুলো কেটেছে উম্মতের ক্ষমা ও মুক্তির প্রার্থনায়। তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার উম্মতের জন্য কেয়ামতের দিনে সুপারিশ করব।’ (আহমদ)

এই অসীম মমতার প্রতিদান দিতে হলে তাঁর দেখানো পথে চলাই একমাত্র উপায়। নবিজির আনুগত্যই তাঁর ভালোবাসার প্রকৃত প্রমাণ।

ভালোবাসার প্রতিদান ও শাফায়াতের আশাবাদ

নবিজির ভালোবাসা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ। আল্লাহ বলেন, ‘যে রাসুলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে।’ (সুরা নিসা : ৮০)
যে ব্যক্তি নবিজিকে ভালোবাসে এবং তাঁর আদর্শে জীবন পরিচালনা করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। কেয়ামতের দিন নবিজি তাঁর উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন, যা হবে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আমার নিকট হতে সবচেয়ে নিকটবর্তী হতে চায়, সে যেন আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে।’ (তিরমিজি)

বিশ্বনবীর প্রেরণার উদ্দেশ্য

আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে পাঠিয়েছেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য, কোনো বিশেষ জাতি বা অঞ্চলের জন্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ (সুরা আল আম্বিয়া : ১০৭)
আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সুরা সাবা : ২৮)

তিনি আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর শিক্ষা ও জীবনাচার মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছে। নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর প্রিয় বন্ধু, কিন্তু এতে আমি গর্ব করি না।’

সমাপনী চিন্তা

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা কোনো আবেগ নয়—এটি ঈমানের ভিত্তি, আমলের প্রেরণা এবং মুক্তির চাবিকাঠি। তাঁর আদর্শে জীবন গঠন করলেই আমরা প্রকৃত অর্থে তাঁর উম্মত হতে পারব।

তাই আসুন, আমরা নবিজির প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের অঙ্গীকার নবায়ন করি। তাঁর সুন্নাহ মেনে চলি, বেশি বেশি দরুদ পাঠ করি, তাঁর আদর্শে সমাজ গড়ি এবং তাঁর শাফায়াত লাভের আশায় জীবন পরিচালনা করি।

মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের হৃদয়ে নবিজির প্রকৃত ভালোবাসা দান করুন, তাঁর সুন্নাহ অনুসরণে তৌফিক দিন এবং কেয়ামতের দিনে তাঁর শাফায়াতের সৌভাগ্য অর্জনের মর্যাদা দিন—আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

ksrm