রাত পোহালেই ভোট, শঙ্কা মানুষের— ‘সত্যি সত্যি হবে, না আগের মতো?’

চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন

সংঘাত কারচুপির আশঙ্কা নিয়েই রাত পোহালেই অনুষ্ঠিত হবে চট্টগ্রাম ৮ আসনের (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) ভোটগ্রহণ। নির্বাচন কমিশনের সব রকমের প্রস্তুতি থাকলেও সাধারণ ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই ভোটে। অনেকে ইভিএমে প্রথমবার ভোট প্রয়োগে নিজেদের অজ্ঞতার কথা যেমন বলছেন, তেমনি গত সংসদ নির্বাচনের মতো ভোট গ্রহণের শঙ্কা থেকেই কেন্দ্রে না যাওয়ার কথা বলছেন তারা। সাধারণের আগ্রহের কমতি থাকলেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ভোটের আমেজ বরাবরের মতোই চরমে।

চট্টগ্রাম ৮ আসনের (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) ভোটগ্রহণ শুরু হবে সকাল ৯টায়। বিরতিহীনভাবে চলবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এরপর ভোটগণনা শেষে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা হবে নগরীর জিমনেশিয়াম হল থেকে।

ধানের শীষের প্রার্থী বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের শঙ্কা প্রকাশ করলেও নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বলছে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে তারা বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রধান দুই প্রার্থীর ঘনিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কি আদৌ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়েই এখনও ধোঁয়াশায় দুই দলই। বিশেষ করে নৌকার প্রার্থীর লোকজন সিনিয়র নেতাদের দিকে থাকিয়ে আছেন ভোটগ্রহণ কোন পদ্ধতিতে হবে তা জানতে। অন্যদিকে ধানের শীষের প্রার্থীর লোকজন ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে আগ্রহ দেখালেও অনিয়ম হলে তা প্রতিরোধেরও প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে তারা।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। একটি শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের মন থেকে ভীতি দূর করতে সব ধরনের পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন সিএমপির উপ কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘উপনির্বাচনটি অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে সব প্রস্তুতি নিয়েছি। ভোটারদের মন থেকে সব ভীতি দূর করতে নির্বাচনের আগের দিন (১২ জানুয়ারি) আমাদের যৌথ টিম নগরীর অধিকাংশ কেন্দ্র ভিজিট করেছি। আমাদের একটিই বার্তা, আপনারা ভোট কেন্দ্রে আসুন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করুন। কেউ যাতে বাধা দিতে না পারে বিষয়টি পুলিশ দেখবে।’

একই কথা বলেছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনাও।

রোববার উর্ধতন পুলিশ কর্মকতারা নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
রোববার উর্ধতন পুলিশ কর্মকতারা নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ৮ আসনের মোট ১৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্র নগরীর অংশে পড়লেও বাকি ৬৯টি কেন্দ্র রয়েছে বোয়ালখালীতে। নগরীতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন প্রায় ১৭০০ পুলিশ সদস্য আর বোয়ালখালীতে ১২৫০ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া প্রত্যেক কেন্দ্রে গ্রাম পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে।

পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি এমন হলেও সাধারণ মানুষের মাঝে ভোট নিয়ে আগ্রহ খুবই কম। বিশেষ করে উপনির্বাচনে সংঘাত ও ভোট গ্রহণ নিয়ে তাদের মনে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে গত সংসদ নির্বাচনে যে স্টাইলে ভোট হয়েছে সে কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন কিনাও সেটা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। পাঁচলাইশের মাসুদা খাতুন নামে ষাটোর্ধ এক নারী ভোটার বলেছেন, ‘বাদলের ভোট তো দিত্ ন পারি। আঁই যাইবের পর হদ্দে তোয়ার ভোট দি ফেলাইয়ে। এবারও এল্লে গরিবু দে এরি। ন যাইয়ুম।’ তাকে সমর্থন জানিয়ে ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ বলেন, ‘ভোট দিতো যাই লাফ (লাভ) নাই। হিতারা লই ফেলাইবু।’ এ সময় রোকেয়া বেগম নামে আরেকজন বলেন, ‘মেশিনে ভোট কেনে দিয়ুম? এগিন তো ন জানি। দরকার নাই এতো কষ্ট গরি ভোট দিতেম।’

বহদ্দারহাটে ফুটপাতে কথা হয় ইব্রাহিম নামে এক বোয়ালখালীর ভোটারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি চান্দগাঁওয়ের ভোটার। প্রথমবার ইভিএমে ভোট দিব। হয়তো আমি ঠিকমতো দিতে পারলেও আমার পরিচিত অনেকেই ইভিএম নিয়ে তেমন কিছু জানে না। তারা সে কারণে কেন্দ্রে নাও যেতে পারে।’

এ সময় পাশে থাকা আজিম নামের একজন বলেন, ‘ভোট দিলেই হবে না। সেটা মেশিনে যদি দুই নম্বরি হয়ে অন্য মার্কায় চলে যায়? দেখি সকালের পরিস্থিতি বুঝে যাব।’

মোবাইলে কথা হয় বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গার ভোটার গৃহবধূ দিলু আরা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভোট দি কী হবে? এসব তো নেতারা নেতারা নিজে নিজে দিয়ে দেয়। এরকম গতবারও নৌকা হয়ে গেছে।’ একই এলাকায় নতুন ভোটার সুমন বলেন, ‘আমি নতুন ভোটার তাই ভোট দিতে যাব। তবে ইভিএম নিয়ে তেমন ধারণা নেই।’

একই উপজেলার চরণদ্বীপের ভোটার রফিক বলেন, ‘গতবারের মতো যদি এক তরফা হয় তাহলে যাব না কেন্দ্রে আর যদি ভোটের মত ভোট হয় তাহলে যাব। তবে ইভিএম নিয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। এখন কোথায় দিলে কোথায় পড়ে সেটা নিয়ে চিন্তা করছি।’

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বোয়ালখালীর সরোয়াতলীর ভোটার আহমদ নবী উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘সত্যি সত্যি ভোট হবে, না আগের মতো?’

ধানের শীষের প্রার্থী মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশনের উপর আমাদের কোনও আস্থা নেই। জনগণের অধিকার ফিরে পেতেই আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। নির্বাচন শুরুর পর থেকেই সরকার লীয় প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ, নৌকার প্রার্থীর লোকজন আমারে পোস্টার ব্যানার ছিঁড়লেও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কালকের নির্বাচন যেন গতবারের পুনরাবৃত্তি না হয় সেই দাবিই করছি। যেই জিতুক জনগণ যেন তার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান। নতুন করে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভোটার ও বিএনপির নেতাকর্মীরে কেন্দ্রে না যেতে হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে নৌকার প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত। আমরা ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। পর্যাপ্ত ফোর্স মোতায়ন করা হয়েছে। আশা করছি উৎসবমুখর পরিবেশে একটি শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবো।’

উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোছলেম উদ্দিন, বিএনপির আবু সুফিয়ান, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এসএম আবুল কালাম আজাদ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ ফরিদ আহমদ, ন্যাপের বাপন দাশগুপ্ত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ এমদাদুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মূলত ভোটের লড়াই হবে বিএনপির আবু সুফিয়ান এবং আওয়ামলী লীগের মোছলেম উদ্দীন আহমদের সঙ্গে। গত কয়েক দিনে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা আর অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ হলেও প্রাণঘাতি কোন সংঘাত হয়নি।

চট্টগ্রাম ৮ আসনটি চট্টগ্রাম জেলার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড এবং বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল ইউনিয়ন, পশ্চিম গোমদন্ডী ইউনিয়ন, পূর্ব গোমদন্ডী ইউনিয়ন, শাকপুরা ইউনিয়ন, সারোয়াতলী ইউনিয়ন, পোপাদিয়া ইউনিয়ন, চরনদ্বীপ ইউনিয়ন, আমুচিয়া ইউনিয়ন ও আহল্লা করলডেঙ্গা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।

চট্টগ্রাম ৮ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৮। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ৯২২ ও নারী ভোটার ২ লাখ ৩৪ হাজার ৭৪ জন। বোয়ালখালী উপজেলায় ভোটার ১ লাখ ৬৪ হাজার। কেন্দ্র সংখ্যা ১৭০টি।

এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৮। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ৯২২ ও নারী ভোটার ২ লাখ ৩৪ হাজার ৭৪ জন। মোট কেন্দ্র রয়েছে ১৮৯টি। এবারই প্রথম এ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে।

গত ৭ নভেম্বর ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাসদের কার্যকরী সভাপতি মঈনউদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুর পর আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm