রাতের চট্টগ্রামে সাংবাদিকের ওপর সাংবাদিকের হামলা, মামলার পর বাসা ভাঙচুরে পুলিশ
সমন্বয়কের ‘প্রভাব’ খাটানোর অভিযোগ
রাতের চট্টগ্রামে এক টিভি সাংবাদিককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে অপর একদল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় থানায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক। এর মধ্যে একজন সাংবাদিককে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছে। সমন্বয়কের উপস্থিতিতে পুলিশ এক সাংবাদিকের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছে বলেও অভিযোগ মিলেছে।
মারধরের শিকার হওয়া ওই সাংবাদিক চ্যানেল টোয়েন্টিফোর চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত শেখ সাইদুল ইসলাম মীর ওরফে ইবেন মীর (৩০)। ফেনী সদরের ফাজিলপুরের বাসিন্দা এই সাংবাদিক সম্প্রতি ‘ক্রীড়া সাংবাদিক’ হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির সদস্য মনোনীত হন। তাকে মারধরের ঘটনায় নাম এসেছে যে দুজনের, তাদের একজন একাত্তর টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সাইফুল ইসলাম শিল্পী এবং অপরজন রূপালী বাংলাদেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান জালাল উদ্দিন সাগর।
‘জিডি কেন করছিস’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) রাত আটটার দিকে কাজির দেউড়ি পুলিশ বক্সের পাশে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক চা খাচ্ছিলাম। এ সময় হঠাৎ সেখানে আসেন ইবেন মীর ও জালালউদ্দিন সাগর। ইবেন মীরকে দেখেই সাইফুল ইসলাম শিল্পী ‘তুই আমার বিরুদ্ধে জিডি কেন করছিস’ বলে কয়েকটি চড়-থাপ্পড় মারেন। এ সময় জালালউদ্দিন সাগর ‘তু্ই শিল্পী ভাইকে চিনিস’ বলে কিল-ঘুষি মারতে থাকে ইবেন মীরকে। পরে আমরা কয়েকজন গিয়ে তাদের মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়াই।’
ওই সাংবাদিক বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পরই পুলিশ নিয়ে সেখানে হাজির হয় ইবেন মীর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদকেও সেখানে দেখা যায়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ জালাল উদ্দিন সাগরকে আটক করে। তবে সাইফুল ইসলাম শিল্পী তার আগেই সেখান থেকে সরে যায়।’
রাতে ঘটনা প্রসঙ্গে ‘মারধরের শিকার’ সাংবাদিক ইবেন মীর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি কাজির দেউড়ি মোড়ে চা খাচ্ছিলাম। এ সময় হঠাৎ জালাল উদ্দিন সাগর এসে সমঝোতার কথা বলে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে যেতেই সাইফুল ইসলাম শিল্পী আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তুই কেন জিডি করছস?’ জবাবে আমি কিছু বলার আগেই শিল্পী আমাকে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে জালাল উদ্দিন সাগরও আমার ওপর হামলা চালায়। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাহিদুল করিম কচি (আমার দেশ পত্রিকার আবাসিক প্রধান), মুস্তাফা নঈম (কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান), আলমগীর সবুজসহ (ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির ব্যুরো প্রধান) আরও কয়েকজন সাংবাদিক। পরে তারা ঘটনা থামাতে এগিয়ে আসেন।’
মামলায় সাতজন আসামি
এদিকে এই ঘটনায় শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন ইবেন মীর। মামলায় মোট সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। এরা হলেন— সাইফুল ইসলাম শিল্পী (৪০), জালাল উদ্দিন সাগর (৫২), আরিয়ান লেনিন (৩৫), নাজমুল ইসলাম (৪০), দৈনিক পূর্বদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক সাইফুল্লাহ চৌধুরী (৫০), কামরুল হুদা (৬০) এবং এম এ হক শামীম (৩৮)।
ইবেন মীর এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামীলীগ সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম ও ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন ও অত্যাচারের নিউজ করার কারণে আসামিরা আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে। একে কেন্দ্র করে আসামিদের সঙ্গে আগে থেকে বিরোধ চলে আসছে। এই বিরোধের জের ধরে আসামিরা বিভিন্নভাবে আমাকে মারধরসহ ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করছিল। আমি এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করি।’
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ‘৩১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে অফিস থেকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে কাজির দেউরি ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে পাকা রাস্তায় দাঁড়াই। এ সময় ২ নম্বর আসামি (জালাল উদ্দিন সাগর) আমাকে ডাক দেয়। আমি তার কাছে যাওয়ার পর অন্য আসামিরা আমাকে মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে ১ নম্বর আসামি (সাইফুল ইসলাম শিল্পী) আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার বুকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মেরে জখম করে। ঘুষির আঘাতে আমি পড়ে গেলে ২ নম্বর আসামি (জালাল উদ্দিন সাগর) আমাকে লাথি ও ঘুষি মারে। এ সময় সাইফুল ইসলাম শিল্পী আমার গলা চেপে ধরে। এ সময় আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলেও আসামীরা আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিল-ঘুষি মেরে জখম করে।’
বাসা ভাঙচুরে পুলিশ
এদিকে শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে সাইফুল ইসলাম শিল্পী ফেসবুকে অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী দোসর কোতোয়ালী থানার ওসি করিমের নেতৃত্বে সেকেন্ড অফিসার শরীফসহ পুলিশ আমার নাসিমন ভবনের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছে। আমার স্ত্রী-সন্তানদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। সমন্বয়ক পরিচয়ধারী কিছু যুবক আমিসহ ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে। পুলিশ কমিশনারকে বলার পরও কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’
ইবেন মীরের পক্ষ নিয়ে সমন্বয়ক রাসেল আহমেদসহ আরও কয়েকজন থানা ও পুলিশের মধ্যে প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে সাইফুল ইসলাম শিল্পীর ঘনিষ্ঠরা অভিযোগ করেছেন। কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়েরের সময়ও সমন্বয়ক রাসেল সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। কোতোয়ালী থানায় উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মাঝরাতে সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি ও শাহনেওয়াজ রিটন মামলার বদলে বিষয়টি সমঝোতায় সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে কোতোয়ালী থানায় গেলে সেখানে উপস্থিত সমন্বয়করা ‘দালাল দালাল’ স্লোগান দেন। এর একপর্যায়ে তারা থানা ছেড়ে চলে আসেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ওই দুই সাংবাদিকের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
মূল দ্বন্দ্ব পদ ভাগাভাগি নিয়ে
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটিতে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে সদস্য মনোনীত হন চ্যানেল টোয়েন্টফোরের সংবাদকর্মী ইবেন মীর। এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হন। তাদের অভিযোগ, ফেনীর বাসিন্দা ইবেন মীর কখনও ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। মূলত কয়েকজন সমন্বয়কের তদবিরে ইবেন মীর অ্যাডহক কমিটিতে স্থান পান বলে তারা অভিযোগ করেন। নিজেদের মনোনীত লোক স্থান না পাওয়ায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের একটি অংশ স্টেডিয়াম এলাকায় মানববন্ধনও করে।
জানা গেছে, এসব ঘটনার জের ধরে আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও হুমকির অভিযোগ এনে গত বুধবার (২৯ জানুয়ারি) কোতোয়ালী থানায় সাইফুল ইসলাম শিল্পীসহ চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেন ইবেন মীর। পরে এর প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে শিল্পীর অনুসারীরা মানববন্ধন করে।
সিপি