সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
রমজানে মুসল্লিদের প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় উপবাস করতে হয়। এ বছর প্রচণ্ড গরমের তাপে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে মানুষ। এই সময়ে লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খুবই সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পবিত্র রমজান মাসে লিভারের রোগে আক্রান্ত রোগীদের করণীয় সম্পর্কে এ লেখায় আলোকপাত করবো।
প্রথমেই জানবো লিভার রোগের কোন্ রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন, আর কারা পারবেন না।
একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস এবং একিউট লিভার ফেইলার
হঠাৎ করে তীব্র জন্ডিসে আক্রান্ত একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস এবং লিভার ফেইলরের রোগীদের লিভারের কার্যক্ষমতা অত্যাধিক মাত্রায় কমে যাওয়ায় তারা রোজা রাখতে পারবেন না।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ
ফ্যাটিলিভার বা লিভারে চর্বি জমা হওয়া বর্তমানে আমাদের দেশসহ সমগ্র বিশ্বের একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। তবে যারা ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন তাদের জন্য রোজা খুবই উপকারী। বলা যায় এটি একটি আশীর্বাদ।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, হেপাটোসাইট বা লিভার সেলের জেনেটিক একটিভিটির তারতম্যের জন্য কম খাবার খেলে ফ্যাটি লিভারের রোগীরা ভালো থাকবেন। উপবাসের সময় লিভার সেলের নানামুখী তৎপরতায় লিভারে ফ্যাট জমা হতে দেয় না। কাজেই অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস এবং অন্যান্য জটিল রোগ সঙ্গে না থাকলে ফ্যাটি লিভারের রোগীরা রোজা রাখলে উপকৃত হবেন।
ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি
হেপাটাইটিস বি কিংবা সি’তে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী যাদের শারীরিক তেমন কোন অসুবিধা নাই এবং লিভার ফাংশন ভালো তারা রোজা করতে পারবেন। তবে যারা এই রোগের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন তারা অবশ্যই যথারীতি ওষুধ চালিয়ে যাবেন।
লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার
সাধারণভাবে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগী যাদের জন্ডিস, পা কিংবা পেটে পানি আসা, রক্ত বমি কিংবা পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস আছে তাদের জন্য রোজা রাখা ক্ষতিকর হতে পারে। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন না।
এবার রমজানে লিভারের রোগীদের খাবার বিষয়ে জানাচ্ছি-
ক) ইফতার
ইফতারের সময় প্রচুর পানি এবং তরল খাবার, কম চর্বি যুক্ত এবং রসালো খাবার ও ফলমুল খাওয়া উচিত। কম তেলে ভাজা দু একটি পেয়াজু-বেগুনি খেতে পারবেন। মাঝারি মাপের একটি জিলাপি এবং ছোট এক বাটি হালিম খেতে পারবেন। তবে এই খাবারগুলো ঘরে বানানো হতে হবে এবং যাদের অ্যাসিডিটি সমস্যা বেশি, তারা এই খাবারগুলো এড়িয়ে চললে ভাল থাকবেন।
১. পানীয়
পানি, দুধ, শরবত, ঘরে বানানো ফলের রস এবং সঙ্গে অল্প পরিমাণ চিনি খেলে সারাদিনের রোজাজনিত পানি শূন্যতা পূরণ হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সতেজ হতে পারবেন।
২. খেজুর
ইফতারের সময় খেজুর খাওয়া সুন্নত। ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমানেরা খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙ্গেন। খেজুরে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক চিনি এবং শক্তি। এছাড়াও রয়েছে পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ এবং ফাইবার। যা মুহূর্তেই মানুষের শরীরকে চাঙ্গা করবে। লিভারের রোগীরাও প্রতিদিন ইফতারিতে ৩-৪টি খেজুর খেতে পারবেন।
৩. ফল
যেকোন ধরনের ফল লিভারের রোগীরা খেতে পারবেন। রসালো ফল বেশি পরিমাণে খেতে পারেন। তবে সাথে ডায়বেটিস থাকলে মিষ্টি ফল বেশি খাবেন না।
৪. সুপ
ভেজিটেবল, চিকেন কিংবা কর্ণ – যে কোন সুপ লিভারের রোগীরা খেতে পারবেন।
খ) রাতের খাবার
ইফতারের পর রাতের খাবার হালকা হতে হবে। এ সময়ে আপনি ভাত অথবা রুটি অথবা পেস্তা সাথে মুরগি, মাছ, সবজি পরিমাণমতো খেতে পারবেন। এ সময় ফ্যাটি লিভারের রোগীরা টক দই খেতে পারেন।
গ) সেহেরি
সেহেরিতে পরিমিত ভাত, রুটি, সবজি, মাছ এবং মুরগি খেতে পারবেন। কম চর্বি দুধ এবং সাথে কলা খেতে পারবেন।
এড়িয়ে চলুন
অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড, গরু ও খাসির মাংশ, বড় চিংড়ি (বিশেষত ফ্যাটি লিভার এবং লিভার সিরোসিসের রোগীরা), অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার, অতিরিক্ত ঝাল খাবার এবং কোমল পানীয়।
রমজানে ব্যয়াম
শারীরিকভাবে সক্ষম ক্রনিক হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভার এবং লিভার সিরোসিসের কোন কোন রোগী ইফতারের পর সাধ্যমত হাল্কা ব্যয়াম কিংবা হাটাহাটি করতে পারবেন।
সবশেষে
চিকিৎসকের যথাযথ পরামর্শ নিয়ে স্বাস্থ্যকর এবং পরিমিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে লিভারের বিভিন্ন রোগীরা মাহে রমজানের ফজিলত লাভ করতে পারেন। সুস্থ থাকুন। আল্লাহ আমাদের সবার সহায় হন।
অনুলিখন: সাইরিন সাকী ও নুসরাত জাহান