যোগ্যতা ছাড়াই তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইটি বিশেষজ্ঞ
৩২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগেও ধোঁকা
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইটি বিভাগে বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করছেন মো. ইকবাল হাসান। ৬ষ্ঠ গ্রেডে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেন তিনি। আইটি বিভাগে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারও আছেন। কিন্তু এই পদে চাকরি করার জন্য ইকবালের দক্ষতা থাকলেও নেই যোগ্যতা।
এছাড়া গত বছর সিটি কর্পোরেশনের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে চাকরি প্রার্থীদের দেওয়া হয়েছে চরম ধোঁকা। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল—‘এমপিওভুক্ত’ শিক্ষকরাই শুধুমাত্র আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টো চিত্র। একাধিক নন এমপিও শিক্ষককে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় চাকরির জন্য।
সিটি কর্পোরেশনের এসব অনিয়মের নেপথ্যে ছিলেন প্রধান নির্বাহী (সিইও) শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম—এমনটাই দাবি সিটি কর্পোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সড়কের বাতি বন্ধ রাখার অপরাধে ১৪ আগস্ট চাকরিচ্যুত হন কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। যদিও সড়কবাতি বন্ধ রাখার পেছনে সিইও তৌহিদের নির্দেশই ছিল বলে অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা।
অযোগ্য লোক যখন বিশেষজ্ঞ
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ১৩ আগস্ট মো. ইকবাল হাসানকে তড়িঘড়ি করে সিটি কর্পোরেশনের কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক থেকে বদলি করা হয় সচিবালয় বিভাগের আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। যদিও কর্পোরেশনের অর্গানোগ্রামে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোনো পদ নেই। তবে মো. ইকবাল হাসান অবশ্য নিজেকে ৬ষ্ঠ গ্রেডের প্রোগ্রামার হিসেবেই পরিচয় দেন।
তবে প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরি করার শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে অবশ্যই কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর বিএসসি ডিগ্রি থাকতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করে আসা ইকবালের নেই সেই যোগ্যতা।
সিটি কর্পোরেশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেন ইকবাল। পরে অনলাইনে কম্পিউটারের ওপর বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শর্ট কোর্সের সার্টিফিকেট নেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘আমি লন্ডনের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর বিএসসি করি।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, যখন থেকে সিটি কর্পোরেশনে কম্পিউটারের কাজ শুরু হয় তখন তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ইকবালকে নিয়ে আসেন। তখন থেকেই সে আইটি বিভাগটি চালাচ্ছে। তার হাতেই গড়েছে এই আইটি বিভাগ। তবে সে কম্পিউটারে দক্ষ, কিন্তু তার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন নেই।’
এর আগেও প্রোগ্রামার পদে চাকরি করতেন ইকবাল। কিন্তু অফিসের গোপনীয় তথ্য বাইরে পাচারের অভিযোগে তাকে শাস্তিস্বরূপ কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবে বদলি করেন সদ্য সাবেক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় ইকবাল আবার স্বরূপে ফেরেন।
মো. ইকবাল হাসানের বিরুদ্ধে করোনাকালীন সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারের সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। পরে চলতি বছরের ২ এপ্রিল এ ঘটনায় শুনানির চিঠি জারি হয়। সেটিতে ১৮ এপ্রিল ইকবালসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে শুনানি হয়।
চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে এক, ভেতরে আরেক
২০২৩ সালের ৪ মে সিটি কর্পোরেশনের ৩২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের ৩৭টি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির অন্যতম শর্ত ছিল, আবেদনকারীকে অবশ্যই এমপিওভুক্ত শিক্ষক হতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে ছিল এক, হয় আরেক।
চূড়ান্তভাবে ১০ প্রধান শিক্ষক ও ২৭ সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয় কর্পোরেশন। বিজ্ঞপ্তিতে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আবেদন করার সুযোগ না থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন ছয়জনকে। এমনকি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজনের শূন্য পদের স্থলে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যোগ্য এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন ‘অযোগ্যদের’।
তবে ঘটনার সম্পূর্ণ দোষ সাবেক মেয়র রেজাউলের কাঁধে তুলে দেন সিইও তৌহিদ। তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের ঘটনা, এই বিষয়টি নিয়ে তখন মেয়র সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। ওনার নির্দেশেই নিয়োগ হয়েছে।’
বিজ্ঞপ্তিতে এক, ফলাফলে আরেক—এ বিষয়ে তৌহিদ বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর কর্পোরেশনে চাকরি করা শিক্ষকরা মেয়র সাহেবকে অনুরোধ করেন, যাতে যারা নন-এমপিও শিক্ষক কর্পোরেশনের স্কুলে আছেন, তাদেরও সুযোগ দেওয়া হয়। সেই মোতাবেক মেয়র সাহেব প্রসেস মেনে, মিটিং করে, নন এমপিওদেরও নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।’
তৌহিদের দাবি, সেই শিক্ষক নিয়োগের কমিটিতে তিনি সামান্য একজন সদস্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বিএস/ডিজে