যাদের শ্রমে উঠছে উঁচু দালান তাদের নেই জীবনের নিরাপত্তা

২৫ এপ্রিল ২০২১। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মো. ইউনুছ নামে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। ঐ দিন দুপুর ২টায় কোতোয়ালী থানার খাতুনগঞ্জে হাজী আমিন রোডে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মো. ইউনুছ রাউজান উপজেলার কমলবতি চৌধুরী বাড়ির বাদশা মিয়ার ছেলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ি সূত্রে জানা যায়, খাতুনগঞ্জে পুরাতন একটি ভবনের তিনতলায় ছয়জন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। ইউনুছ তিন তলা থেকে চার তলায় উঠার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। পরে হাসপাতালে আনা হলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

২৪ মার্চ ২০২১। চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের কাজের সময় দুর্ঘটনায় এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও একজন। দুর্ঘটনায় নিহত জসীম উদ্দিনের (৩০) বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামে। আহত মো. শরীফ (৩৫) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার তখন জানান, চন্দনপুরা ইসলামী ব্যংক ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের সময় মিকশ্চার মেশিনের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন জসীম ও শরীফ। তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক জসীমকে মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রামে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা এরকম দুটো ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ না। প্রায়শই: ঘটছে এরকম মৃত্যুর ঘটনা। কাজ করতে গিয়ে এসব গরীব-অসহায় মানুষগুলো ফিরছেন লাশ হয়ে। কিন্তু মাসে বা বছরে চট্টগ্রামে কতজন নির্মাণ শ্রমিক মারা যাচ্ছেন এরকম হিসেব নেই জেলা নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে।

চট্টগ্রাম জেলা নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, এ সংগঠনের আওতায় সদস্য সংখ্যা ৩ হাজার ৪০০ জন। সংগঠনের সভাপতি মো: রুস্তম আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে আমরা আমাদের সংগঠনের সদস্যদের দেখভালের চেষ্টা করি। তারা আহত হলে মালিকপক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য তদবির করি।’

চট্টগ্রামে বছরওয়ারি মৃত্যুর পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সারাদেশে কতজন শ্রমিক বছরে মারা যান তার তথ্য পাওয়া গেছে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনের পরিসংখ্যান থেকে। জানা গেছে, মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব, শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ মৃত্যুর বাইরে শ্রমিকদের পঙ্গু হওয়ার পরিসংখ্যানও বেশ উদ্বেগজনক।

শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া নিয়োগকারী কাউকে কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না। আইনে রয়েছে এমনি বাধ্যবাধকতা। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত ও কিংবা জনবসতি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বা ব্যক্তিগত মালিকানায় ভবন তৈরিতে নির্মাণ শ্রমিকদের কোন নিরাপত্তা নেই। ঝুঁকিপূর্ণভাবে দড়িতে ঝুলে বিল্ডিংয়ের রঙ, পাইপ লাগানোসহ নানারকম কাজ করতে দেখা গেছে। হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা তো অনেক দূরের কথা।

এ সম্পর্কে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শিল্প স্বাস্থ্য সেফটি কমিটি’ গঠন করতে বলা হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ইনসাবের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক। বেশিরভাগ নির্মাণ শ্রমিক মারা যায় মাথায় ইট পড়ে, বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে, প্রাচীর ভেঙে, দড়ি ছিড়ে, ইত্যাদি।

ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) কেন্দ্রীয় কমিটির পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৬ সালে ২২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৪৬ জন, ২০১৮ সালে ১৮৭ জন, ২০১৯ সালে ১৮৫ জন, ২০২০ সালে ১৯৭ জন নির্মাণ শ্রমিক নিহত হয়েছেন।

নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে দেখা যায়, হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই কাজ করছেন বেশিরভাগ শ্রমিক। নির্মাণাধীন ফ্লোরের মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বৈদ্যূতিক তার, নির্মাণ কাজের কাঁচামাল, ব্যবহৃত পানি ও নির্মাণ সামগ্রী। তবে এত ঝুকিপূর্ণভাবে শ্রমিকরা কাজ করলেও কর্মস্থলে তাদের নিরাপত্তা নীতিমালা সম্পূর্কে জানেন না।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সচেতনতামূলক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উঁচু স্থানে কাজ করার সময় লিফট, সেফটি বেল্ট, শক্ত দড়ি-মাচা ব্যবহার; কাজের সময় মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের তারের কাছে ভেজা রড ওঠানো-নামানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই নির্দেশনায়। কিন্তু এসব নির্দেশনা যে খুব একটা মানা হয় না তা সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টের (সেরিড) এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি সংগঠনটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্মাণশিল্পে কর্মক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ শ্রমিক সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া উপযুক্ত নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে তাঁরা নানা ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করছেন। কিন্তু দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সংগঠনটির সুপারিশ মালায় উল্লেখ আছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্মাণ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। নিজস্ব নীতিমালা তৈরি করতে হবে। তাদেরই শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি তদারক করতে হবে। আর সরকারকে এসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে।

উপেক্ষিত শ্রমিকদের অধিকার
আজ (১ মে) মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্মত্যাগে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক অবিস্মরণীয় দিন। দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামেও পরিচিত। কিন্তু এ শ্রমিক দিবসেও উপেক্ষিত শ্রমকিদের অধিকার। ন্যায্য পাওনা তো নেই-ই, নেই ছুটিও। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হে মার্কেটে রক্ত ঢেলেছিলেন যে শ্রমিকরা আজ এত বছর পরও তা অর্জিত হয়নি। শুধু কাগজে-কলমে আর আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ মে দিবসের অধিকার।

মে দিবসেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। বিশেষ করে নির্মাণ শ্রমিকদের ছুটি মিলেনি মে দিবসেও। সারা বছরের মতোই উপেক্ষিত থাকল তাদের মে দিবসও।

চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে নগরের চকবাজার এলাকার টুপিওয়ালা পাড়ায় রাত জেগে কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। তাদের কাছে তিনি জানতে চান, শ্রমিক দিবসের কথা। তারা জানেনইনা, পহেলা মে শ্রমিক দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি আলাদা দিবস রয়েছে, যেদিন অন্তত একটা দিন ছুটি পাওয়ার কথা তাদের। কিন্তু সে ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত তারা। এভাবেই চট্টগ্রামে পালিত হচ্ছে মেহনতি শ্রমিকদের মে দিবস।

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!