ইনিও নেতা!/ মেয়র নাছিরের ছবি লাগিয়ে চোরের ‘গডফাদারের’ পোস্টার
পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক জানিয়ে এলাকায় পোস্টার সেঁটেছিলেন সোহেল আহমেদ রানা। তার নামের পাশে রাজনৈতিক পরিচয় ছিল বাকলিয়া থানা শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
পোস্টারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ছবি ছাড়াও মেয়রের দুই অনুসারী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা হাজী শফিকুল ইসলাম ও মাসুদ করিম টিটুর ছবিও ছিল। ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার দেখলে যে কারো মনে হবে সোহেল আহমেদ রানা আপাদমস্তক একজন শ্রমিক নেতা!
গত রমজানের ঈদে নিজ এলাকায় নিজেকে শ্রমিক লীগ নেতা দাবি করে পোস্টারও লাগান সোহেল রানা।
বুধবার (২৮ আগস্ট) গভীর রাতে যখন চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ার বগারবিল এলাকা থেকে সোহেল রানাকে কোতোয়ালী থানা পুলিশ আটক করে, তখনই সবার ভুল ভাঙলো। পুলিশ বলছে, গ্রেফতার হওয়া সোহেল রানা চট্টগ্রাম নগরীতে সক্রিয় চোরের দলের ‘গডফাদার’। তার দলের সদস্যরা নগরীর দুর্ধর্ষ সব চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত।
পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকালে সোহেলের কাছ থেকে ল্যাপটপ, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন চোরাই মালামাল এবং একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সোহেল নিজেকে শ্রমিক লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে গত ৬ বছর ধরে নগরে চোরের একটি চক্র পরিচালনা করে আসছে।
গ্রেপ্তার সোহেল কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর ধন্যারপাড়ের মৃত মোহন মাঝির ছেলে এবং বাকলিয়া থানার শান্তিনগর বগারবিলে ইসলাম ভিলায় থাকতেন।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন এ বিষয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা চোর চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন নামের একজন আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছে বাকলিয়ার সোহেল তাদের ‘বড় ভাই’। এ বড় ভাইয়ের নির্দেশেই নগরীর বাসাবাড়িতে চুরি করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল চকবাজার-বাকলিয়া এলাকায় প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে শেল্টার (আশ্রয়) দেয় বলে তথ্য দিয়েছে। আমরা এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছি।’
ওসি আরও বলেন, ‘সোহেলের ছত্রচ্ছায়ায় ৮ থেকে ১০ জন কিশোর ও তরুণের একটি চক্র নগরের বিভিন্ন এলাকায় চুরি করে। তারা চুরি করে চোরাই মালামাল সোহেলকে দিত। সোহেল সেগুলো বিক্রি করতো। সোহেল এই ছেলেগুলোকে নিয়মিত ইয়াবা সেবনের টাকা দেয়। ইয়াবা খাইয়ে তাদের দিয়ে চুরি করায়।’
সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চকবাজার-বাকলিয়া এলাকায় প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে শেল্টার দেয় । আমরা এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছি।
কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘গত ১৯ জুন নগরীর সার্সন রোডে জনৈক এঞ্জেলিনা গোমেজের বাসায়, ৯ আগস্ট চট্টেশ্বরী মোড়ে জনৈক আব্দুল হামিদ সওদাগরের বাসায়, ৯ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজির দেউড়ির সানমার এলিভেরা বিল্ডিংয়ে জনৈক মো. আব্দুল্লাহর বাসায়, ১৬ আগস্ট সিরাজউদ্দৌলা রোডে জনৈক রুহুল আমীনের বাসায় চুরি হয়। এসব চুরি সোহেলের চোর দলের সদস্যদের মাধ্যমে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আনোয়ার মালিঙ্গা, মাসুদ আলি, শাকিল প্রকাশ রেন্ডি, হৃদয়সহ কমপক্ষে ১০ জন শিশু-কিশোর আছে, যারা কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত জিনিস সোহেলের দোকানে বিক্রি করে। সোহেল নিজেই ফুসলিয়ে এসব শিশু-কিশোরকে চোর বানিয়েছে। সোহেল তাদের টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে তারা ইয়াবা সেবন করে। কখনো কারও হাতে টাকা না থাকলে সোহেল তাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে। পরে তারা যখন চুরির মালামাল বিক্রি করতে আসে, তখন সেখান থেকে টাকা কেটে নেয়। গত ৬ বছর ধরে সোহেল এভাবে নগরীর বিভিন্নস্থানে চুরি সংঘটিত করে আসছে।’
এদিকে সোহেল রানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক কামরুজ্জামান।
সোহেল রানার রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক এটলী বলেন, ‘পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে বা থানায় আমাদের কোনো বৈধ কমিটি নেই। সভাপতি বখতেয়ার উদ্দিন খান একটি কমিটি দিয়েছেন, যেখানে সোহেল নামে এই যুবক সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সম্ভবত আছে। আমি পাল্টা আরেকটি কমিটি দিয়েছি।’
চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী দিয়ে শ্রমিক রাজনীতি করা যায় না বলেও জানান মাহবুবুল হক এটলী।
জানা গেছে, সোহেল মূলত চোরাই মালামাল কেনে এবং বিক্রি করে। শ্রমিক লীগের পরিচয়ের পাশাপাশি চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে যুবলীগ নেতা আমজাদ হোসেন ‘বড় ভাই’ হিসেবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় সোহেলকে। আমজাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবার জন্য তাকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। আমজাদ পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাসুদ করিম টিটুর অনুসারি। গত জুলাইয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হেরেছেন মাসুদ করিম টিটু। ওই নির্বাচনে টিটুর পক্ষে কাজ করেছে বলে দাবি করেছে সোহেল। মাসুদ করিম টিটু আবার সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে পরিচিত।