মেয়রের ‘স্নেহে’ এক সুদীপ বসাকের হাতে পদোন্নতির চেরাগ
উপ-সহকারী থেকে অবিশ্বাস্য গতিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী!
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময়কালে কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রায় ভেঙে পড়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি এতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে অনিয়মের পদোন্নতি। এরই এক উদাহরণ যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক। উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দিয়ে ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকার পরও মাত্র ১০ বছরেই তিনি হয়ে উঠেছেন রীতিমতো তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
নানা অভিযোগ থাকলেও তদন্ত বা শাস্তি তো দূরের, উল্টো তার হয়েছে শণৈ শণৈ পদোন্নতি। এমনকি প্রচলিত রীতি না মেনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ধার না ধেরে তার পদোন্নতিগুলোও হয়েছে স্বয়ং মেয়রের স্বাক্ষরে। সর্বশেষ পদোন্নতির আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানিতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেই। যোগ্যতা যাচাই-বাছাই, কমিটি গঠন ছাড়াই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যান্ত্রিক বিভাগের এই কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে দফায় দফায়।
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে সুদীপ বসাককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার তিন সহকর্মী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে যান্ত্রিক শাখায় (পুল) উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন সুদীপ বসাক। ২০০৯ সালের ২৬ নভেম্বর সুদীপ বসাকসহ আরও পাঁচ উপ-সহকারী প্রকৌশলীর চাকরি নিয়মিত করা হয়। তবে শর্ত ছিল, নিয়মিত করার দুই বছর সন্তোষজনক চাকরিকাল অতিবাহিত করার পর সবাইকে স্থায়ী করা হবে। কিন্তু যোগদানের ১২ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সুদীপ বসাকের বিরুদ্ধে গাছ চুরির অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা দায়ের করেন সিটি করপোরেশনের এস্টেট কর্মকর্তা এখলাস উদ্দিন আহমেদ।
এই মামলা ছাড়াও নানা অভিযোগের পরও তাকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো তার চাকরি স্থায়ী করা হয় ২০১১ সালের ২০ নভেম্বর। ওই সময় সুদীপ বসাককে অতিরিক্ত সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্বও দেওয়া হয়। আ জ ম নাছির মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৭ জুন যান্ত্রিক বিভাগের সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পান সুদীপ বসাক। এতে চসিকের ওই অফিস আদেশেও স্বাক্ষর দেন মেয়র। অথচ সেখানে স্বাক্ষর করার কথা ছিল করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৯৯৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর যান্ত্রিক বিভাগের অ্যাসফল্ট ও রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন মো. সামশুজ্জামান সেলিম। ২০০০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ওই বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন তৌহিদুল হাসান। ২০০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন আনু মিয়া। ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি সিএনজি রিফুয়েলিং প্ল্যান্টের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন ওহিদুল্লাহ। ২০০৪ সালের ২৪ মে গার্বেজ ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্টের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন সাদেকুল আজম। আর সবশেষে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই যান্ত্রিক শাখা (পুল) বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন আলোচিত এই সুদীপ বসাক।
যেসব যোগ্যতা থাকা জরুরি
২০১৮ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে অস্থায়ীভাবে এক হাজার ৪৬টি পদে যোগ্য ও বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয়। এতে উপ-সহকারী পদে সরাসরি নিয়োগ পেতে স্বীকৃত ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান থেকে (পুল/যান্ত্রিক/বিদ্যুৎ) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ হওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। সহকারী প্রকৌশলী পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক/সমমান ডিগ্রি পাশ এবং উপ-সহকারী পদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসহ চাকরিবৃত্তান্ত সন্তোষজনক হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে সরাসরি নিয়োগ পেতে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যান্ত্রিক প্রকৌশলী স্নাতক ডিগ্রিসহ নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ৫ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসহ চাকরির অন্যান্য বৃত্তান্ত সন্তোষজনক হওয়া বাধ্যতামূলক।
বিস্ময়করভাবে নিয়মনীতি ছাড়াই সুদীপ বসাককে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদ থেকে স্থায়ীকরণের ৪ বছরের মাথায় সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ এই নিয়োগ পেতে হলে ৭ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসহ স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যান্ত্রিক বিষয়ে স্নাতক পাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সুদীপ বসাকের ক্ষেত্রে এর কোনটিই মানা হয়নি। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হলেও মূলত তিনি দায়িত্ব পালন করছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন তিনি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেকানিক্যাল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রাম মেনে আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। আমার পদোন্নতি দেখে অনেকেই হিংসা করছেন। কে কী বলল, এসব নিয়ে আমি চিন্তা করি না।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামশুদ্দোহা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চসিকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে এই পদোন্নতি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এতে পদোন্নতির ৫ সদস্যের কমিটি পূর্ণ মতামতের ভিত্তিতে সুদীপ বসাককে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে এই পদে অন্য কেউ নেই বিধায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিক) শুধু সুদীপ বসাক নিয়ে এতো মাতামাতি করছেন কেন বুঝলাম না? চসিকের আরও অনেকেই আছেন এই সমস্যায়। তাদের নিয়ে লেখেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এসএস/সিপি