পণ্যের আড়ালে মদ/ পার পেয়ে যাচ্ছে শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে তরল কোকেন আটকের ঘটনায় শিপিং এজেন্ট কসকো শিপিং লাইনস অভিযুক্ত হয়েছিল। কিন্তু মেশিনারির আড়ালে মদের চালান আটকের ঘটনায় শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানি কী করে পার পেয়ে যাচ্ছে—এতে বিস্মিত খোদ কাস্টমসেরও অনেকে।

মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা নিষিদ্ধ মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চালানবহনকারী পানামা পতাকাবাহী এমভি কিউজি শান জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির নাম আড়াল হয়ে যাচ্ছে রহস্যজনক কারণে। অথচ ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেলের মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য তরল কোকেন আটকের ঘটনায় শিপিং এজেন্ট কসকো শিপিং লাইনসকেও সংশ্লিষ্ট করে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক একেএম আজাদকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পালন করে যাচ্ছে রহস্যজনক নীরবতা।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, চীনের সাংহাই থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে আনা নিষিদ্ধ মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় এ পর্যন্ত সিএন্ডএফ এজেন্ট ও বার্জ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ধরাছোঁয়ার রয়ে গেছে বাইরে জাহাজের এজেন্ট।

এক সপ্তাহ আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজের প্যাকেজে ঘোষণাবর্হিভূত চীনা ওইসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকের পর প্রাথমিকভাবে খালাস রোধে সিএন্ডএফ এজেন্টের এআইএন নম্বর ‌‘লক’ করে দিলেও জড়িত শিপিং এজেন্টের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাৎক্ষণিকভাবে সিএন্ডএফ এজেন্টের এআইএন নম্বর ‘লক’ দেয়ায় আমদানি করা আট চালানের সব পণ্য হ্যান্ডলিংসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে শিপিং এজেন্টের নাম। ফলে সাধারণভাবে আমদানি নিষিদ্ধ এসব মদ-বিয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য জাহাজে মিথ্যা ঘোষণায় পরিবহনে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কাস্টমসের রহস্যজনক নীরবতায় রহস্য আরও দানা বাঁধছে।

শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির কর্ণধার শাহ আলম বাবুল। তিনি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ডিস্টিক্ট ৩১৫-বি৪ এর সাবেক গভর্নর। যোগাযোগ করা হলে শাহ আলম বাবুল বলেন, ‘জাহাজে অনেকগুলো আমদানিকারকের পণ্য থাকে। শিপিং এজেন্ট হিসেবে ওই চালানে কী নিয়ে আসা হচ্ছে তা আমাদের জানার কথা না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিপার (সরবরাহকারী) পণ্য জাহাজিকরণের পর ওই চালানে কী পণ্য আছে তা অবশ্যই শিপিং এজেন্টকে জানিয়ে দেওয়া হয়। মেশিনারি পণ্য ঘোষণা দিয়ে ওই পণ্যের সাথে মাদক নিয়ে আসার ঘটনা কোনোভাবেই শিপিং এজেন্টের অজানা থাকার কথা নয়। চীনা প্রতিষ্ঠান জাহাজটিতে সাংহাই বন্দরে এসব চালান জাহাজিকরণের পর থেকেই মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরেও শিপিং এজেন্ট এসব পণ্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ হিসাবে ঘোষণা দেয়। এক্ষেত্রে সিএন্ডএফ এজেন্টের মতো দায় তাদেরও। জাহাজ থেকে মিথ্যা ঘোষণায় খালাসকালে এসব পণ্য আটকের ঘটনায় প্রথম দায় শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ায় শিপার (সরবরাহকারী) ওই চালানে কী কী পণ্য আছে তা বিল অব লেডিংয়ের মাধ্যমে শিপিং এজেন্টকে অবহিত করে। কিন্তু মোট ৮ চালানের ৬৬৯ প্যাকেজে ক্যাপিটেল মেশিনারিজের আড়ালে মদ ও অন্যান্য পণ্য ধরা পড়ে। রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির ব্যবস্থাপক জাফর উল্লাহ খোকন বলেন, বিল অব লেডিং অনুযায়ী ওই চালানগুলোতে ক্যাপিটেল মেশিনারি পণ্যের ঘোষণা ছিল। এর বাইরে মাদক বা অন্যান্য পণ্যের বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। চালানে বিপুল পরিমাণ মাদক নিয়ে আসার ঘটনাটি শিপিং এজেন্টের অজানা কিভাবে থাকলো—এ বিষয়ে জাফর উল্লাহ খান বলেন, যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তারা সবাই বলবে এই ঘটনা সম্পর্কে শিপিং এজেন্টের জানার কথা নয়।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে আলাপ করে জানা গেছে, শিপিং এজেন্টকে না জানিয়ে মাদকের চালান নিয়ে আসার ঘটনাটি তাদের অজানা থাকবে—বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক। চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগে মিথ্যা ঘোষণা এবং চোরাচালানের পণ্য ধরা পড়ার ঘটনায় শিপিং এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও এ ঘটনায় রহস্যজনকভাবে ব্যতিক্রম ভূমিকা পালন করছে কাস্টমস। চট্টগ্রাম বন্দরে বহুল আলোচিত ভয়াবহ মাদকদ্রব্য তরল কোকেন আটকের ঘটনায় শিপিং এজেন্ট কসকো শিপিং লাইনকে দায়ী করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ওই ঘটনায় কসকো শিপিং লাইনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (কর্পোরেট, বিক্রয় বিপণন) একেএম আজাদকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই চালানটি ভোজ্য তেলের ঘোষণায় আনার পর খালাসকালে ড্রামভর্তি কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

চীনের সাংহাই থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে আনা বিপুল পরিমাণ মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায়ও দেখা গেছে, কাস্টমসের শুল্ক আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী জাহাজের এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর জেটিতে অবস্থানরত জাহাজ থেকে রিভার সাইটের তিনটি বার্জে ওই পণ্য খালাস শুরু করেছিল তাদেরই দায়িত্বে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান জানান, ওই চালানগুলোর ইনভেন্ট্রি করা হবে। জাহাজটিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ৬ নম্বর বার্থে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ঘটনায় শিপিং এজেন্টের সম্পৃক্ততা আছে কিনা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, চীনের সাংহাই থেকে আট চালানে ৬৬৯ প্যাকেটে এক হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ নিয়ে এমভি কিউ জি শান নামের একটি মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। বন্দরের ৩ নম্বর জেটিতে বার্থিং নেওয়ার পর বার্জ খালাস করার সময় মদ, বিয়ারসহ খাদ্যসামগ্রী থাকার বিষয়টি উদঘাটিত হয়। গত ২৩ জুলাই পণ্য খালাসকালে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে আটক হয় চালানটি

এসসি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!