মেরামত শেষ হয় না চট্টগ্রামের বেহাল সড়কের, কাজ শেষ হতেই ফের গর্ত (ভিডিও)
নিম্নমানের পাতলা বিটুমিনই শেষ করে দিচ্ছে সব
চট্টগ্রাম নগরীতে জনচলাচলের জীর্ণ সড়কগুলোর সংস্কার নিয়ে চলছে রীতিমতো প্রতারণা। কয়দিন পর পর বিভিন্ন সড়কে তৈরি হওয়া গর্তগুলো ভরাট করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেখানে আবার তৈরি হয় গর্ত ও খানাখন্দ। তাতে গাড়ি তো বটেই, মানুষের পথচলাচলেই পোহাতে হয় অশেষ দুর্ভোগ। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার না করে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে সড়ক সংস্কার করায় কিছুদিন পরই সড়ক ফের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই বিটুমিন এতোই পাতলা যে, রাস্তায় ঢালাইয়ের পর তার ওপর দিয়ে গাড়ি গেলেই চাকার সাথে লেগে বিটুমিন উঠে যায়।

চট্টগ্রামে সড়ক সংস্কারের এই দুর্ভোগ যেন শেষ হওয়ার নয়। প্রতিবছর একই অনিয়ম, একই ধারা চলছেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরল বিটুমিনের ব্যবহার, ইট-পাথর-খোয়ার পরিবর্তে মাটি-বালির ওপর রাস্তা ঢালাই ছাড়াও কার্পেটিংয়ের পরপরই যানবাহন চলাচলের কারণে চট্টগ্রাম নগরীতে সড়ক সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত মান মেলে না কখনোই।
অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণেই এই করুণ অবস্থা তৈরি হচ্ছে বছরের পর বছর। এর আগে ঠিকাদারদের কাজে অনিয়ম-গাফিলতি পাওয়া গেলে লাইসেন্স বাতিল ছাড়াও তাদের কালো তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৯ দশমিক ২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পিচ ঢালাই সড়ক রয়েছে ৯০০টিরও বেশি। পাশাপাশি ২৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কংক্রিটের সড়ক আছে এক হাজার ২৭টি।
নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ স্থানেই ছোট-বড় গর্ত এবং খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। বারিক বিল্ডিং থেকে বন্দর-কাস্টমস সড়কটি দিয়ে নগরবাসীর চলাচলের ভোগান্তি ক্রমেই বাড়ছে। এসব সড়কের ভাঙ্গা অংশ সংস্কার করা হলেও তাতে দেখা গেছে বড় ধরনের অনিয়ম। বিটুমিন মেশানো ইট-পাথরে দেখা গেছে বিটুমিনের প্রলেপ খুবই কম। বিটুমিন দিয়ে সড়কের কাজ করার কোন নিয়মই ভালোভাবে মানা হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) নগরীর আগ্রাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে সড়ক সংস্কারে বিটুমিনযুক্ত ইট-পাথর-নুড়িতে বিটুমিনের প্রলেপ খুবই পাতলা। রাস্তায় ঢালাইয়ের পর তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যেতেই বিটুমিন চাকার সাথে লেগে উঠে যায়। একই দৃশ্য দেখা গেল বহদ্দারহাট সড়কেও।
বিমানবন্দর সড়ক এলাকার রিকশাচালক সাগর মিয়া জানান, ‘কয়দিন পরপর গর্তগুলো ভরাট করে। কিন্ত আগের মতই আবার গর্ত, খানা-খন্দে ভরে যায়। রিক্সা চালাতে কষ্ট হয়ে যায়।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন সড়কের সংস্কারকাজে তদারকি কম থাকায় ঠিকাদাররা কম দামের ৮০-১০০ গ্রেডের তরল বিটুমিন ব্যবহার করছেন। এতে সড়কগুলো অল্পতেই আবার নাজুক দশায় পড়ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ৮০-১০০ গ্রেডের পরিবর্তে ৬০-৭০ গ্রেডের গাঢ় বিটুমিন ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে ঠিকাদাররা বাস্তবে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনের কথা বলে দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছেন। এজন্য সড়কের স্থায়িত্বও হচ্ছে কম।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইকবাল এন্ড ব্রাদার্সের প্রোপ্রাইটর ইকবাল হোসেন রোকন দাবি করেছেন, ‘আমি সবসময় আমার প্রতিষ্ঠানের কাজের জন্য ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন কিনি। তাই আমার কেনা বিটুমিনের ঘনত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারে না।’
ইকবাল হোসেন এমনটি দাবি করলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন উপ-প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ইকবাল এন্ড ব্রাদার্স মূলত আমদানি করা ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিনই ব্যবহার করছে।
জানা গেছে, চলাচলের রাস্তা বন্ধ না করে কার্পেটিং করায় তাও টিকছে অল্পদিনই। তবে ঠিকাদাররা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরীর যেসব সড়কে সংস্কারকাজ চলছে, তার প্রায় সবই ওই এলাকায় চলাচলের একমাত্র সড়ক হওয়ার কারণে সংস্কারকাজে সমস্যা হচ্ছে। বিকল্প পথ থাকলে সংস্কারকাজ স্থায়ী করা সম্ভব হতো বলেও জানান তারা। দেখা গেছে, রাস্তা কার্পেটিংয়ের পরপরই শুরু হয়ে যায় গাড়ি চলাচল। অথচ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরাই বলছেন, রাস্তা কার্পেটিংয়ের পর অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সড়ক চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।
সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি সাধারণত ৮০/১০০ এবং ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে। যার মধ্যে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন অনেক বেশি টেকসই। দেশের সড়ক এবং আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনই এখানকার সড়কের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু বাস্তবে বেসরকারিভাবে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে সড়ক সংস্কার করায় কিছুদিন পরই সড়ক ফের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংস্কারকাজ শেষ হতে না হতেই নতুন করে আবারও একই সড়কের জন্য প্রকল্প নিতে হচ্ছে সরকারকে। সবমিলিয়ে একই সড়ক বারবার রক্ষণাবেক্ষণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি গুণতে হচ্ছে সরকারকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিটুমিন দিয়ে রাস্তায় কাজ করার সময় কয়েকটি স্তরে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে মাটি কাটার কাজ, ইটের ফ্লাট সোলিংয়ের কাজ, হেরিং বোন বন্ডের কাজ, রাস্তার দৈর্ঘ্য বরাবর উভয় খাড়া ইটের এজিং, বিটুমিনাস কার্পেটিং, ট্যাক কোট, সীল কোট, বালি দিয়ে রাস্তার উপরিভাগ আচ্ছাদনসহ আরও কিছু কাজ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘আমি আমার যথাসাধ্য দিয়ে সড়ক সংস্কারে নজরদারি করেছি। ঠিকাদারদের সাথে পেরে উঠা কঠিন। তারপরও গাফিলতি করলে রক্ষা নেই।’
আইএমই/সিপি