মেডিকেলেই পা পড়েনি, ৫ বছর ধরে ‘ডাক্তার’ তিনি সিটি কর্পোরেশনের!

ডাক্তারই নন, যোগ্যতাও নেই—অথচ রীতিমতো নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘ডাক্তার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক)। নাম তার শাহেদুল আনোয়ার। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৮ নং শুলকবহর ওয়ার্ড অফিসের ‘হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক’ তিনি। শুলকবহর ওয়ার্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তার পরিচিতি লেখা রয়েছে—ডা. শাহেদুল আনোয়ার আদর, পদবি ডিএইচএমএস মেডিকেল অফিসার! চসিকে ‘ডাক্তার’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার এক মাস পর ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের চকবাজারে অবস্থিত আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে। সবেমাত্র শেষ করেছেন চতুর্থ বর্ষের পাঠ।

মেডিকেলে ভর্তি না হয়েই কিভাবে তিনি সিটি কর্পোরেশনের ‘ডাক্তার’ হয়ে উঠলেন, তার আদ্যন্ত খুঁজতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল পিলে চমকানো সব তথ্য।

এদিকে কোনোরকম যাচাই-বাছাইয়ের তোয়াক্কা না করে অনেকটা মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে কাগজপত্র দেখেই শাহেদুল আনোয়ার নামের এক ব্যক্তিকে ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ দেয় চসিক। কথিত ডাক্তার শাহেদুল আনোয়ার ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট চসিকের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদের স্বাক্ষরিত পত্রে ৮ নং শুলকবহর হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়ে হোমিও চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। কমিটিতে থাকা ৮ কর্মকর্তার কাছেও নিয়োগের অনুলিপি পাঠানো হয়। অভিযুক্ত শাহেদুল আনোয়ার ওই সময় যেসব একাডেমিক সনদপত্র নিয়োগ কমিটিকে দেখিয়েছেন, তার সবগুলোই ছিল বানানো এবং জাল সনদপত্র।

নিয়ম অনুযায়ী একজন চাকরিপ্রার্থীর সকল সনদপত্র যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়, কিন্তু নিয়োগ কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের কষ্টটুকু করতেও রাজি হয়নি। ফলে সবার চোখ ফাাঁকি দিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘ডাক্তার’ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন শাহেদুল আনোয়ার নামের ওই ব্যক্তি। এমনকি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের এক কর্মকর্তা চসিক কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করার পরও টনক নড়েনি চসিকের। বেতন উল্টো ৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

ডাক্তার না হয়েও কিভাবে রোগী দেখছেন—অনুসন্ধান চলাকালে এমন প্রশ্নের জবাবে অভিযুক্ত শাহেদুল আনোয়ার বলেন, ‘চারতলায় বসি। তাই রোগী এমনিতে অনেক কম আসে। তবে আমার কিছু টেলিফোনে রোগী আসে, পরে গিয়ে সেবা দিয়ে আসি। কখনও দুজন-একজন, আবার কখনও ৭ জন, আবার কোনোদিন আসেও না। আসলে প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট তো ওইসব দেখি।’

চসিকে 'ডাক্তার' হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার এক মাস পর ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের চকবাজারে অবস্থিত আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে।
চসিকে ‘ডাক্তার’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার এক মাস পর ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের চকবাজারে অবস্থিত আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে।

যেভাবে ধরা পড়ল সনদপত্রের জালিয়াতি
কথিত ডাক্তার শাহেদুল আনোয়ার যেসকল একাডেমিক সনদপত্র জমা দিয়েছেন তার সবগুলোই ছিল ভুয়া। যার প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন সনদপত্র অনুসারে যে ‘২২০০৯’ রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া আছে তা ভুল এবং রেজিষ্ট্রেশন সনদপত্রে থাকা তারিখ দুই জায়গায় দুই রকম। রেজিস্ট্রেশনের ওপরের তারিখে লেখা আছে ২০১১ সালের ২১ মে। অন্যদিকে রেজিস্ট্রেশনের নিচে থাকা তারিখে আছে ২০১১ সালের ২৯ মে। অন্যদিকে রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরও নকল। কারণ ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের রেজিস্ট্রার হিসেবে আছেন জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু অভিযুক্ত শাহেদুল আনোয়ারের রেজিস্ট্রেশন সনদপত্রের স্বাক্ষরটি রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমের নয়।

আরেকটি সনদপত্র ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৬৪৮০/২০০৪-০৫। প্রকৃতপক্ষে এ নম্বরের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। তারিখ এবং রেজিষ্ট্রেশন সনদপত্রের লেখাও দুই রকমের। যা সহজেই চোখে পড়ে।

অভিযুক্ত শাহেদুল আনোয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে জানান, ‘১৯৯৯ সালে এসএসসি দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগের পড়াশোনা শেষ করি ২০০৭ সালে। এরপর মেডিকেলে পড়াশোনা করি, ডিপ্লোমা করি, ফার্মেসি নিয়ে পড়ি। আমার সবকিছুই আছে যখন যেটা কাজে লাগে আর কি!’

ডাক্তার না হয়েও জাল সনদ দিয়ে নিয়োগ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে কাউন্সিলর সাহেব আমাকে অনেক বিশ্বাস করেন, পছন্দ করেন তো—তাই থাকতে হয়।’

শুলকবহর ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোরশেদ তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি তো সে সময় ছিলাম না। ২০১৪ সালে যিনি ছিলেন তিনি হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তাছাড়া আমি ২০১৪ সালে আসার পর তাকে পেয়েছি। সেক্ষেত্রে সে ডাক্তার কিনা তা তো আমি জানবো না।’

নিয়োগের এক মাস পর মেডিকেলে ভর্তি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডাক্তার না হয়েও নিয়োগকে জায়েজ করতেই নিয়োগের এক মাস পরে ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভর্তি হন চট্টগ্রামের চকবাজারে অবস্থিত আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে আসে কথিত ডাক্তার শাহেদুল আনোয়ার বর্তমানে আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে সবেমাত্র চতুর্থ বর্ষ শেষ করেছেন। এখনও তার ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ বাকি! নিয়ম অনুযায়ী চতুর্থ বর্ষ শেষ করে ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ শেষে বোর্ডে আবেদনের পর সাময়িক চিকিৎসক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। এরও পর কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়।

‘এই ছেলে মাত্র ফোর্থ ইয়ার শেষ করলো’
কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডাক্তার ফেরদৌস চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই ছেলে আমাদের কলেজের ছাত্র। সে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভর্তি হয়েছে। মাত্র ফোর্থ ইয়ার শেষ করলো। ইন্টার্নশিপ করবে সামনে।

প্রতারণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এমন কাজ সত্যিই দুঃখজনক। সবাইকে ঠকিয়ে চিকিৎসাসেবার মতন মহান পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সে।’

ওই প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল অফিসার ডা. ইস্কান্দার ছাত্রের পরিচয় পেয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওহ্ শাহেদুল আনোয়ার। এই ছেলেটা এই বছর ফোর্থ ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে। ইন্টার্নশিপে ভর্তি হবে। কল করেছি। সে এখনও আসেনি।’

দায় এড়াচ্ছেন নিয়োগ কমিটির কর্তারা
২০১৪ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হোমিও স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনার জন্য যে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয় তার যাবতীয় চিকিৎসা সনদপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য হোমিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডাক্তার জাকির হোসেন সিটি করপোরেশন হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. নুরুল আমিনকে প্রধান করে নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়।

কিন্তু ডা. নুরুল আমিন পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘নাহ! আমি তো এ রকম কাউকে চিনি না।’ নিয়োগ কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি—এমন প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ কমিটি করে করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এখানে তো আমার জানার কিছু নেই। যখন ডাক্তার নেবে, পেপারে বিজ্ঞপ্তি দেবে, তারপর যাচাই-বাছাই শেষে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। এরপরে নিয়োগ হবে—এটাই তো সিস্টেম। আমি কোনো যাচাই-বাছাই কমিটিতে ছিলাম না।’

অধ্যক্ষ ডা. নুরুল আমিন এরপর বলেন, ‘যেদিন আমাদের ডাকা হয়, সেদিন আমি ছাড়া আরেক ডাক্তার ছিল। তারপর আরও মানুষ ছিল আর আমি তো দশজনের একজন। আমাদের ডাকাইছে শুধু প্রশ্ন করার জন্য। কিন্তু তাদের কাগজ যাচাই-বাছাই করা আমাদের দায়িত্ব ছিল না। সে ডাক্তার কি ডাক্তার না সে তো যিনি যাচাই-বাছাই করেছেন তিনি বলতে পারবেন। আমরা কাগজপত্র দেখিনি। কেবল প্রশ্ন করেছি।’

যিনি ডাক্তারই নন, তিনি ডাক্তারের যোগ্যতা যাচাইয়ের মৌখিক পরীক্ষায় কিভাবে উত্তীর্ণ হলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নুরুল আমিন বলেন, ‘আমাকে বেশি প্রশ্ন করতে দেয়া হয় নাই। আলী আহমেদ (সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) সাহেব সব প্রশ্ন করছে। আমি নামমাত্র ছিলাম।’

এখন আবার কারও ‘কিছু জানা নেই’!
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার আসলে জানা নেই। তাই তেমন বলতে পারবো না। আপনি বরং আমাদের সংস্থাপন শাখার সচিব সাহেবের সাথে কথা বলেন। উনাদের কাছেই সকল ফাইলপত্র বা নোটিশ আছে। আর আমি বিষয়টি দেখবো।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘আসলে আমি সে সময় ছিলাম না। আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে ওই ডাক্তার কিভাবে নিয়োগ পেয়েছে সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। খতিয়ে দেখার পর প্রমাণিত হলে সে যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যাচাই বাছাই নিশ্চয় হয়েছে কিন্তু এর মধ্যে এমন ঘটনা পুরো সিটি করপোরেশনকে প্রতারিত করেছে।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংস্থাপন শাখার উপ সচিব মো. আশেক রসুল চৌধুরী বলেন, ‘তখনকার সময় তো আমি ছিলাম না। আর এটা দায়িত্বের বাইরে যায় না। আমরা বিষয়টা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমন যদি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যাচাই-বাছাই করা অবশ্যই নিয়োগ কমিটির দায়িত্ব। এক্ষেত্রে হয়তো টোটালি ভেরিফাই করে নাই। তাই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!