মুম্বাইয়ের ইরফান খান এসেছিলেন রাঙামাটিতেও

রোকেয়া প্রাচীর স্মৃতিচারণ

আমাদের আশা ছিল, প্রার্থনা ছিল, ইরফান খান ফিরে আসবেন। কিন্তু হঠাৎ সকলই শূন্য মনে হচ্ছে। এভাবে তিনি বিদায় নেবেন ভাবতে পারছি না। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে! মন খারাপ করা এই সময়ে আরো বেশি মানসিক চাপ বোধ করছি। খারাপ লাগছে। এই খারাপ লাগাটাও প্রকাশ করতে পারছি না।

তার চলে যাওয়া মানে সহকর্মী হারিয়েছি বা বলিউড ইন্ডাস্ট্রির লোকসান হলো- তা নয়। আমি মনে করি, ইরফান খানের চলে যাওয়ায় পুরো দুনিয়ার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোকসান হয়েছে। বেঁচে থাকলে আরো ভালো কিছু তার কাছ থেকে আমরা পেতাম। তার জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। তিনি খুবই সিনসিয়ার, প্রফেশনাল, দায়িত্ববান পারফর্মার ছিলেন। একজন বড় অভিনেতা তো এমনিতেই হয় না। এক্সট্রিম কিছু গুণাবলি দরকার হয়- এই গুণগুলো তার মধ্যে ছিলো। যে কারণে খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

‘ডুব’ সিনেমার শুটিং পিরিয়ডে ইরফান খানকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি! তাকে খুব কাছ থেকে দেখলে তার শত্রুও তাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলার সুযোগ পেতেন বলে আমার মনে হয় না। কাজের ক্ষেত্রে তিনি এতোটাই সিনসিয়ার, দায়িত্ববান ছিলেন। প্রফেশনালি কাজ করতেন। যা করতেন নিখুঁতভাবে করতেন। তার সঙ্গে কাজ করতে পেরে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছি। খুব আনন্দ পেয়েছি! সহ-অভিনেতা যদি পরিণত হন, খুব ভালো মানুষ হন, সচেতন হন, রাজনৈতিকভাবে স্ট্রং হন— তাহলে কাজ করাটা খুব আনন্দের হয়। তিনি যথেষ্ট হেল্পফুলও ছিলেন।

আমরা যখন ‘ডুব’ সিনেমার রিহার্সেল করতাম, তখন পরিচালক কথা বলার পর খানিক সময়ের গ্যাপ তৈরি হতো। তখন আমার সঙ্গে চরিত্র নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন। বলতেন, আপনি এভাবে তাকালে আমি এভাবে এক্সপ্রেশন দেব, এভাবে লুক দেব। এই যে মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করে নেওয়া এটা তিনি না করলেও পারতেন। কিন্তু তার এই কো-অপারেশন খুব ভালো লাগত।

অভিনয় শুধু করার জন্য করছি, ইরফান খানের কাছে বিষয়টি এমন ছিল না। তিনি তার মেধা-মনন কাজে লাগাতেন। শুটিংয়ের সময় অনেক অভিনয়শিল্পী আরেকজনকে বিরক্ত করে থাকেন। যেমন ধরুন, লাইট নিতে পারছে না। কিংবা এমনভাবে দাঁড়ালেন তাতে অন্যের সমস্যা হচ্ছে তা খেয়ালই করলেন না। কিন্তু ইরফান খান এসব বিষয়ে এতোটাই যত্নশীল ছিলেন যে বলে বোঝানো যাবে না।

তার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে পুরো সময়টা উপভোগ করেছি। খুবই ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। প্রথম দেখাতেই আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি অসাধারণ একজন মানুষ। অসাধারণ মানুষ হলেই তো অসাধারণ শিল্পী হওয়া যায়। শিক্ষিত, ভীষণ দক্ষ- এরকম শিল্পী খুব কম হয়।

ইরফান খানের স্ত্রী সুতপা সিকদার বাঙালি। কিন্তু ইরফান খান খুব ভালো বাংলা বলতে পারতেন না। কিন্তু সেটে যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন ততক্ষণ বাংলা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। মাঝেমধ্যেই দেখতাম গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। বিষয়গুলো খুব ভালো লাগতো।

একবার শুটিংয়ের জন্য রাঙামাটি গিয়েছিলাম। ভীষণ গরম পড়েছিল। এত গরম যে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। নন-এসি গাড়ি ছিলো। যে গাড়ি দিয়ে পাহাড়ি এলাকায় চলতে হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ইরফান খানকে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি। এতো গরমের মধ্যে কাজ করছেন— এ নিয়ে কোনো অভিযোগও করেননি কখনো।

একজন আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে পারাটা আমার জন্য অবশ্যই গ্রেট এক্সপেরিয়েন্স। ইরফান খান গ্রেট পারফর্মার। এরকম পারফর্মার ভারতবর্ষে আবার আসবে কিনা সন্দেহ! বলিউডে অনেক বড় সুপারস্টার আছেন, তবে ইরফান খান ইজ ইরফান খান। হঠাৎ তার চলে যাওয়ায় আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হলাম।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!